দেশের অর্থনীতিতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার অবদান রাখা ফুলের বাজারকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে ফেলেছে করোনাভাইরাস। সময়মত বিক্রি করতে না পারায় নষ্ট হয়ে গেছে শত শত বিঘা জমির ফুল। পুঁজির বড় একটা অংশ হারিয়ে দিশাহারা অসংখ্য ফুলচাষী। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ ফুলচাষ ছেড়ে নেমেছেন সবজি উৎপাদনে। এতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ফুলের বিক্রি কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
দেশের ফুল ব্যবসায়ীদের দুই সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটি’ ও ‘ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি’র তথ্যে উঠে এসেছে ফুল ব্যবসয়ীদের এমন করুণ চিত্র।
সংগঠন দুটির তথ্যমতে, দেশের অভ্যন্তরে বছরে প্রায় ১২শ থেকে ১৫শ কোটি টাকার ফুলের ব্যবসা হয়। কিন্তু করোনার কারণে বিক্রি কমে বছর শেষে তা দাঁড়াতে পারে ৫শ থেকে ৬শ কোটি টাকায়। এই হিসাবে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফুল ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংকটময় এই পরিস্থিতিতে কর্মচারী, দোকান ভাড়াসহ আনুসঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এমন অবস্থায় সরকারের বিশেষ সহযোগিতা ছাড়া এ খাতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা।
ফুল বিক্রির বর্তমান পরিস্থিতি জানতে সরেজমিনে রাজধানীর শাহাবাগ ও আগারগাঁওয়ের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলেছে চ্যানেল আই অনলাইন।
এ বিষয়ে আগারগাঁওয়ের পাইকারি ফুল মার্কেটের এফ টি জেড মাহি ফ্লাওয়ার শপের বিক্রয় প্রতিনিধি তানভির আহমেদ বলেন, করোনার আগে যে বিক্রি হয়েছিল অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের বিক্রির চেয়ে এখন বিক্রি অনেক কমে গেছে। বলা চলে তিন ভাগের এক ভাগও বিক্রি নাই।
কারণ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে, এতে বিয়েশাদি বা সামাজিক অনুষ্ঠান, নানা ধরনের পারিবারিক আয়োজন কমে গেছে। তাই মানুষ ফুল কিনছে না।
তিনি বলেন, করোনার কারণে লকডাউন দেয়ায় বাগানের মালিকেরা ফুল চাষ করে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ কারণে তারা উৎপাদনও কমিয়ে দিয়েছে।
একই মার্কেটের হাসুপরি ভ্যারাইটিজ গ্যালারীর মালিক মোস্তফা কামাল লিটন বলেন, স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ বেচাবিক্রি হতো, এখন তার চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, ঢাকার সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফুল আসে। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিতে এসব জেলার ফুল বাগানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেক ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষেতে চাষও হয়েছে কম। এ কারণে সরবরাহ কমেছে। তাই করোনার আগের চেয়ে ফুলের দাম এখন তুলনামূলক বেশি।
সরকারের কাছে সহায়তা চেয়ে এই ফুল ব্যবসায়ী বলেন, করোনায় ফুল চাষী ও ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে ফুলের উৎপাদন এবং সরবরাহ ঠিক রাখতে এদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া জরুরি।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় পাইকারি ফুলের বাজার রাজধানীর শাহাবাগে। এই বাজারের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি শ্রী বাবুল প্রসাদ।
তিনি বলেন, করোনার কারণে দেশে সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ধস নেমেছে ফুলের ব্যবসায়। এক কথায় করোনায় এই খাতটি ধ্বংস হয়ে গেছে।
“যেসব চাষী ফুল ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে তারা রিটার্ণ (মুনাফা) পায়নি। অনেক চাষী ফুল ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সবজি চাষে ফিরে গেছেন- এমন প্রমাণও আছে আমাদের কাছে।”
বাবুল প্রসাদ আরও বলেন, ইপিবি এবং ব্যাংকের হিসাব মতে, দেশে প্রায় ১২শ কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে। অর্থাৎ ফুল ব্যবসায় এই পরিমাণ লেনদেন হয়ে থাকে। কিন্তু এবার করোনা যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তাতে মৌসুম শেষে হয়তো লেনদেনের পরিমাণ ৪শ থেকে ৫শ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।
তিনি বলেন, করোনাকালে ফুল ব্যবসায় পাইকারি বাজারেই দৈনিক গড়ে ক্ষতি হয়েছে দেড় কোটি টাকা। এখন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ব্যবসা চালু রয়েছে। আবারও করোনা বাড়ছে। এতে আমরা খুবই আতঙ্ক।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দেশে সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদন হয় যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলায়। কিন্তু আম্পানে এসব এলাকায় উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঢাকার সাভারেও ফুল চাষ হয়। এখানেও বন্যায় অনেক ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া চাষীরা লকডাউনে উৎপাদন করেছে ঠিকই। কিন্তু বিক্রি করতে পারেনি। লকডাউনে উৎপাদিত ফুল বিক্রি করতে না পেরে চাষীরা গরু-ছাগলকে খাওয়াইছে। তাই তারা এখন উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। নতুন করে যেগুলো উৎপাদন হচ্ছে সেগুলো জানুয়ারিতে আসবে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। বড় লোকেরা ভয়ে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান করছে না। এ কারণে তারা ফুলও কিনছেন না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত বিক্রি আগের মত হবে না।
ফুল ব্যবসার বাৎসরিক চিত্র তুলে ধরে ইমামুল হোসেন বলেন, প্রতিবছর দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ১৫শ কোটি টাকার ফুলের ব্যবসা হয়ে থাকে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮শ কোটি টাকা। কিন্তু মনে হচ্ছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত আনুমানিক ৬শ থেকে ৭শ কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে।
“কিন্তু আবারও যদি লকডাউন বা চলাফেরায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তাহলে উৎপাদন চেইন একেবারেই ভেঙে যাবে। ব্যবসায় ধস নেমে আসবে।”
বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়ায় বর্তমানে ফুল রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে এই ফুল বিক্রেতা বলেন, দেশে যে পরিমাণ ফুল উৎপাদন হয়, সেগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্যও যথেষ্ট নয়। তাই রপ্তানি করা যাচ্ছে না। তবে সরকারের সহযোগিতা পেলে ফুল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো সম্ভব। তখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
ফুল ব্যবসায়ী সমিতিগুলোর তথ্যমতে, দেশের প্রায় ২৩ জেলায় ফুলের চাষ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার সাভার। তবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় যশোরে। দেশের চাহিদার তিন ভাগের দুই ভাগই উৎপাদন হয় এই জেলায়।
দেশে সাধারণত গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিউলাস, রজনীগন্ধা, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল উৎপাদন হয়। এছাড়াও লংস্টিক রোজ, লিলিয়াম, জারবেরা, স্টোমা, কার্নিশনসহ কয়েক জাতের ফুল আমদানি করা হয়।
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, সারাদেশে বর্তমানে ৬ হাজারের বেশি ছোট-বড় ফুলের দোকান আছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই রয়েছে সাড়ে ৬০০ ফুলের দোকান। তবে ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, নববর্ষ, বিজয় দিবসসহ উল্লেখযোগ্য দিবস উপলক্ষ্যে পাড়া-মহল্লায় ফুলের ক্ষণস্থায়ী দোকান খুলে অনেকেই এ ব্যবসা করে থাকেন।
বিজ্ঞাপন