থাকেন বহুতল ভবনের সপ্তম তলায়, লিফট নেই, লিফট থাকলেও এখন নিচে নেমে কলম-খাতা, ডিম কিংবা মশার কয়েল কিনতে ইচ্ছা করছে না। স্মার্টফোন অ্যাপ দিয়ে এসব টুকটাক কেনাকাটা করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘরে পৌঁছে দেয়ার রোবট থাকলে কত সহজ হয়ে যেতো সব! শুধু নিত্যপণ্য নয়, যদি মোবাইলফোন অ্যাপ দিয়েই বাসায় ডাকা যেতো গৃহকর্মী! তাহলে চড়া বেতনে রাখা গৃহকর্মীর নানা অজুহাত এবং তার স্বেচ্ছাচারিতার হাতে জিম্মি হওয়া থেকে মুক্তি মিলতো অনায়াসে। কিন্তু যেখানে স্থায়ী গৃহকর্মীর ওপরই ভরসা করা যায় না। সেখানে অ্যাপ দিয়ে বাসায় গৃহকর্মী ডাকা! এও কি সম্ভব? অল্প শিক্ষিত গৃহকর্মী স্মার্টফোন অ্যাপ চালাবে কিভাবে? তাই আপাতত এরকম সেবা কল্পবিজ্ঞান বলে মনে হতে পারে।
কিন্তু ২০১৭ সালে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া মেহেদী স্মরণ ও তার বড় ভাই যেন এই কল্পবিজ্ঞানকেই বাস্তবে নিয়ে আসে ‘রোবটডাকো’ অ্যাপের মাধ্যমে।
যেভাবে যাত্রা শুরু
চ্যানেল আই অনলাইনকে রোবটডাকো’র স্বপ্নদ্রষ্টা মেহেদী স্মরণ বলেন: ঢাকায় যে আমরা একটি ভবনের সপ্তম তলায় থাকতাম। কোন লিফট ছিলো না। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কিন্তু সেই মুহূর্তে জরুরি জিনিস কেনার দরকার পড়তো। এরকম পরিস্থিতিতে সেই দরকারি জিনিসটি বাসায় পৌঁছে দেয়ার অ্যাপের ভাবনা মাথায় আসে আমার। প্রথমে ভেবেছিলাম ‘ডেইলি নিডস’ নামের একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই সেবা চালু করবো।
চ্যালেঞ্জ নিয়েই চালু
চাইলেই ভাবনার বাস্তবায়ন হয়ে যাবে এমনটা নয়। এজন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। ভাবনা বাস্তবায়নের পথে চড়াই-উৎরাইগুলো তুলে ধরে স্মরণ বলেন: প্রথমেই আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার আইডিয়া শেয়ার করি। সে পর পর দুইবার এসব হবে না বলে উড়িয়ে দেয়। তবু ‘ডেইলি নিডস’ দিয়ে আমরা শুরু করি। কিন্তু ওয়েবসাইট দিয়ে গ্রাহকের কাক্সিক্ষত সাড়া পাচ্ছিলাম না। এরপর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান লিখনের মাথায় আসে অ্যাপের ভাবনা। তবে এই অ্যাপ করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। কারণ শুরুর দিকে দু’টি অ্যাপ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিলেও অ্যাপ বুঝে পাননি তারা। তাতে হতাশ না হয়ে অবশেষে ‘রোবটডাকো’ অ্যাপ বুঝে পান তারা।
মানুষ তো আর রোবট নয়। তবু দৈনন্দিন প্রয়োজনে রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে ঘরের দরজায় আন্তরিক এবং চৌকষ কর্মীদের পৌঁছে দিতে অ্যাপটির এই নামকরণ করেন তারা।
স্টার্টআপ দাঁড় করানোর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিলো বিনিয়োগ। বাড়ি থেকে টাকা এনেই অফিস, অ্যাপের খরচ মেটানোর আগে বাবাকে বোঝানোটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো বলে জানান স্মরণ।
তিনি বলেন: উদ্যোক্তাকে পুঁজি পাওয়ার জন্য প্রেজেন্টশন দিতে হয়। আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো বাবাকে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে রোবটডাকোর জন্য টাকা দিতে রাজি করানো। বাবা সনাতনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝারি ব্যবসা করা মানুষ। প্রযুক্তি নির্ভর এইধরণের সেবা ব্যবসা সম্পর্কে তাকে বোঝাতে হয়েছে। তিনি নিজে পাবনা থেকে ঢাকায় আমাদের কাজ দেখতে আসেন। অবশেষে তিনি টাকা দিতে রাজি হন।
ডাক পাচ্ছে রোবটডাকো?
এতো চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে রোবটডাকো যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের জুলাইতে। সেবছরই অক্টোবর থেকে বাড়ি বাড়িতে অনডিমান্ড গৃহকর্মী সরবরাহ করতে শুরু করে স্মরণ-লিখনের রোবটডাকো। প্রথম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয় লোকবল সংকট। প্রচলিত পদ্ধতিতে গৃহকর্মী সিন্ডিকেটের বাইরে খুব কম গৃহকর্মী অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করতে আগ্রহ দেখান। মাত্র ৪ জন গৃহকর্মীকে নিয়ে শুরু হয় রোবটডাকোর গৃহকর্মী সেবা। এখন মোট গৃহকর্মীর সংখ্যা ১০ জন।
তাদের সবাইকে গৃহকর্ম এবং পেশাদারি আচরণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে জানিয়ে স্মরণ বলেন: আমাদের গৃহকর্মীদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের হাতে স্মার্টফোন দিয়েছি আমরা। বাসায় কাজ করতে গিয়ে কোনরকম সমস্যায় পড়লে তারা তাদের মোবাইল ফোনের ইমার্জেন্সি বাটনের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারবেন। গ্রাহকরা তাদের সমস্যা-অভিযোগ জানাতে পারবেন আমাদের হটলাইন নাম্বারে। সেবা চালু করা এলাকাগুলোতে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করি আমরা।
তিনি আরও জানান, স্মার্টফোন রোবটডাকো অ্যাপটি ইন্সটল করে বর্তমানে ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা গৃহকর্মী ডাকতে পারছেন। আপাতত প্রতি মিনিট ৭৫ পয়সা হিসেবে ঘণ্টা ভিত্তিক সেবা দিচ্ছেন আমাদের গৃহকর্মীরা। গ্রাহকরা সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যেকোন সময়ে রোবটডাকো’র গৃহকর্মী ডাকতে পারবেন। ডাকলেই রোবটডাকো প্রশিক্ষিত গৃহকর্মীকে মোটরসাইকেলে পৌঁছে দেবে গ্রাহকের বাসায়।
ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরের স্মার্ট বাসিন্দা ছাড়াও এখন প্রশিক্ষিত গৃহকর্মী সরবরাহের অ্যাপ হিসেবে রাজধানী জুড়ে পরিচিতি পেয়েছে রোবটডাকো। এটাই আপাতত রোবটডাকোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে উদ্যোক্তা বলেন: শুরুতে আমরা গৃহকর্মী সরবরাহ করবো এটা ভাবিনি। কিন্তু ফেসবুকে এই সেবা চালুর পোস্ট দিয়ে দারুণ সাড়া পেয়েছি আমরা। আমাদের এখন গৃহকর্মী আছেন মাত্র ১০ জন অথচ প্রতিদিন ২০০-২৫০ টি কল আসছে। লোকবল কম থাকায় আমরা গ্রাহকদের চাহিদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।
তাই রাজধানীজুড়ে গৃহকর্মী সরবরাহ সেবা ছড়িয়ে দিতে এবং অ্যাপটি আরও গ্রাহক বান্ধব করতে এখন ব্যস্ত রোবটডাকোর উদ্যোক্তারা।
একই সঙ্গে গৃহকর্মীর মানবিক মর্যাদাকে প্রাধান্য দিয়ে ‘রোবটডাকো’ নাম বদলে নতুন নামে সেবা দিতে আগ্রহী উদ্যোক্তারা। তবে এটা এবছরই সম্ভব হবে না। কারণ আপাতত একটু শক্ত পায়ে দাঁড়াতে চায় রোবটডাকো।