জিয়া পরিবার কি ‘মাইনাস’?

একাদশ নির্বাচন-উৎসব শুরু হয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি-বিতরণের এই পর্যায়ে ধানমণ্ডি ও নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের এই স্রোতের প্রভাব পড়েছে সারাদেশের দলটির নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের মাঝে। কেবল এ দুই দলই নয়, জাতীয় পার্টিসহ সকল রাজনৈতিক দলই মনোনয়ন বিক্রি করছে, অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করছে। এর ফলে দেশের সকল রাজনৈতিক দলই যে নির্বাচনমুখী এবং তাদের নেতাকর্মীদের মাঝেও এই নির্বাচনের আমেজ যে সঞ্চারিত হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য।

কেবল আওয়ামী লীগ-বিএনপিই নয়, জাতীয় সংসদের বর্তমান বিরোধীদল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, চরমোনাই পীরের ইসলামি শাসণতন্ত্র আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, ডা. এ কি এম বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরীর বিকল্পধারা বাংলাদেশসহ সকল দলই দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। দলভেদে আবার একেক দলের মনোনয়ন ফরমের একেক মূল্য; আওয়ামী লীগ-বিএনপির মনোনয়ন ফরমের মূল্য যেখানে ত্রিশ হাজার টাকা, সেখানে আ স ম রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) নিচ্ছে পাঁচশ’ টাকা; আবার সিপিবি-গণফোরাম দিচ্ছে বিনামূল্যে। দলগুলোর এই মনোনয়ন বিক্রিতে সারাদেশের ভোটের আমেজ সঞ্চারণের যে ধাপ শুরু হয়েছে তাতে রসদ যোগাচ্ছে ক্রিকেটার, সাবেক ফুটবলার, সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনোনয়ন সংগ্রহের খবর। রাজনীতিবিদ নন অথচ দেশব্যাপী তাদের পরিচিতির সুবাদে তারাও আলোচনায়।

পাঁচ বছর আগে যে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল, প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল তারাও নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়েছে। দলটি ইতোমধ্যেই মনোনয়ন ফরম বিক্রিও শুরু করে দিয়েছে। নয়াপল্টন অভিমুখে নেতাকর্মীদের স্রোতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে যে দাবি জানিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছিল, সেই দাবি পূরণ না হলেও তারা নির্বাচন করছে। তবে আগের অবস্থা থেকে এখনকার অবস্থা তাদের আরও খারাপ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত থাকলেও এখন তিনি কারাগারে। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই দুই মামলার রায় হয়ে গেছে। হাই কোর্টের আপিলেও একটা মামলার রায়ে শাস্তি আরও বেড়েছে। ফলে আইনত তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে পড়েছেন।

খালেদা জিয়া ছাড়াও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার রায়ে শাস্তি হয়েছে। আইন-আদালতের দৃষ্টিতে তিনি পলাতক। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ‘সারেন্ডার’ করে ইংল্যান্ডের ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ নেওয়ার আবেদন। যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টির নিষ্পত্তির খবর এখনও না এলেও তিনি যে বাংলাদেশে সহসা ফিরছেন না সেটা নিশ্চিত। একইসঙ্গে এও নিশ্চিত, প্রচলিত আইনে তিনিও নির্বাচনের অযোগ্য। এরবাইরে আছে বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় তার নাম না থাকা।

ভোটার তালিকায় নাম না থাকায়, ফৌজদারি মামলায় তার দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া এবং আইন-আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক তারেক রহমানও নির্বাচনে নাই, যদিও তিনি কখনও নির্বাচন করেননি। সরকারের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না তার কোনোকালে, তবে তিনি প্রবল শক্তিমান ছিলেন আগের বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। সেসময়ে ‘হাওয়া ভবন’ সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।

মরহুম জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে রাজনৈতিক দল গঠনের শেষ পর্যায়ে গঠন করেন বিএনপি। অন্য অনেকের সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী ডান-বামদের সমাবেশ ঘটান দলে, রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেন তার দলে। তার দুঃখজনক মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন, এরপর একটা পর্যায়ে তাদের বড় পুত্র তারেক রহমানকে দলে পদ দেন। সেসময় থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতা হতে যাচ্ছেন তারেক রহমান। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির সকল পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দেয়। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন। খালেদা-তারেককে দেশত্যাগের শর্তে মুক্তি দেওয়া হলেও খালেদা জিয়া দল ও দেশ ছেড়ে বিদেশে যাননি, কিন্তু তারেক রহমান চিকিৎসার নাম করে দেশত্যাগ করেন। খালেদা জিয়া দলের নেতাকর্মীদের দিকে তাকিয়ে দলের হাল ধরলেও তারেক সেটা করেননি। তারেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চললেও তিনি দেশে ফিরে সেগুলো মোকাবেলা করার সাহস দেখাননি, কিন্তু খালেদা জিয়া সেটা করে গেছেন।

মামলা মোকাবেলার বিভিন্ন পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়া দেশের বাইরে গেলেও আবার দেশে ফিরেছেন। কিন্তু তারেক রহমান সেটা করেননি, উপরন্তু লন্ডনের বিলাসী জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ‘সারেন্ডার’ করে ইংল্যান্ডের ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ের’ আবেদন করেছেন। তার মা দেশে কারান্তরীণ হলেও তিনি দেশে ফেরার চেষ্টা করেননি, মায়ের পাশের দাঁড়াননি, নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াননি। পরিবার ও দলের দুঃসময়ে তিনি নিজের স্বার্থের দিকটাই দেখে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর নিজেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেও ঘোষণা করেন।

মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের প্রতি কটূক্তি এবং ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিক বক্তৃতার কারণে বাংলাদেশের আদালত তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেন। ফলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হলেও তারেকের বক্তব্য বাংলাদেশে প্রচার নিষিদ্ধ। এমন অবস্থায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদটি দখল করে তিনি কেবল দলের কর্তৃত্ব নিজের কাছেই রেখেছেন, এর বেশি কিছু নয়। এমনকি এই পদ দখলের কোনো প্রভাবও নাই দলে-দেশে। আদালতে একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না, পারছেনও না।

তারেক রহমান খালেদা জিয়ার মত একাধিক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত, তবে খালেদা জিয়া দেশের কারাগারে রয়েছেন। বিএনপিও আইনি লড়াই চালাচ্ছে তার জন্য। এ লড়াইয়ের ফল ভবিষ্যতের হাতে। তবে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণের পাঠ শুরুর দিনে দলটি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নামে তিনটি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ফেনী-১ এবং বগুড়া ৬ ও ৭ এই তিনটি আসনে নির্বাচন করবেন। খালেদা জিয়ার নির্বাচন সম্পর্কে এখনই চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য না করলেও ইসি জানাচ্ছে তার মনোনয়ন সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার। ইসির এই বক্তব্যে তাড়াহুড়োর লক্ষণ নেই এবং এটা কৌশলী। এ নিয়ে তারা এখনই কোন উত্তেজনা সৃষ্টি করতেও আগ্রহী নয়। এটা ভালো লক্ষণ।

বিএনপিতে অনেক বড় বড় আইনজ্ঞ, তারাও জানেন ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবু তারা খালেদা জিয়ার জন্য তিনটা মনোনয়ন ফরম কিনে তাদের মনোনয়ন ফরম বিক্রির কার্যক্রমের সূচনা করেছেন। বাস্তবতা বিবেচনায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া অসম্ভব। তবে এই মনোনয়ন ফরম যে প্রতীকী আয়োজন সেটা বলা যায়। কারণ এর আগে একাধিকবার একাধিক অনুষ্ঠানে কারাগারে থাকা খালেদা জিয়াকে ‘প্রধান অতিথি’ করেছিল বিএনপি। ব্যানারেও প্রধান অতিথি হিসেবে খালেদা জিয়ার নাম লিখেছিল তারা। মঞ্চের একটা চেয়ারও খালি ছিল, এমনকি চেয়ার সামনের ছোট্ট টেবিলেও ছিল একটা পানির বোতল। এসব যে প্রতীকী ছিল সেটাও প্রমাণ হয়েছিল সে সময়ে তাদের কজন নেতার গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে।

খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না, তারেক রহমানও একইভাবে নির্বাচনে অযোগ্য; তাদের বাইরে আরও নাম আসছে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের। কয়েকটি গণমাধ্যম সহ বিভিন্ন জায়গায় একই আলোচনা। তবে ডা. জোবাইদা রহমানও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না সেটাও নিশ্চিত। খালেদা-তারেকের মত জোবাইদা দেশের কোনো আদালত কর্তৃক দণ্ডিত নন, কিন্তু তারেকের মত তিনিও দেশের বাইরে এবং তিনিও ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশী। এখনই তারও দেশে ফেরার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তাছাড়া দেশে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রচলন ও ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময়ে তিনিও ছিলেন অনুপস্থিত। সে হিসেবে ভোটার তালিকার তার নাম থাকার কথা নয়। দেশের ভোটার না হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার এবং ভোট প্রয়োগের সুযোগ থাকছে না তার। তাই এবার জোবাইদা রহমানের নির্বাচন করার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়না।

খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে ছাড়া নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়া দেশের আসন্ন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে, এতে দেশেরই লাভ। তবে বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়াটা হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেককে ‘মাইনাস’ করেই নির্বাচনে যাওয়া। এরবাইরে ডা. জোবাইদা রহমানসহ জিয়া পরিবারের কেউই এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। সেক্ষেত্রে বিএনপির জন্যে এই নির্বাচন কেবল ‘মাইনাস-টু’ই নয়, বিএনপির এই নির্বাচন জিয়া পরিবারকে ‘মাইনাস’ করেই নির্বাচন।

বিএনপি যতই বলে আসুক খালেদা জিয়া মুক্ত না করে নির্বাচনে যাব না, তাদেরকে খালেদা জিয়াকে ছাড়াই নির্বাচনে যেতে হচ্ছে। যতই তারা কারাগারে থাকা খালেদা জিয়াকে প্রধান অতিথি করে জনসভা করুক, মনোনয়নপত্র কিনুক, ভাবগম্ভীর কিংবা আবেগি কথা বলুক তারা কার্যত খালেদা-তারেক এবং জিয়া পরিবারকে ‘মাইনাস’ করেই এগিয়ে যাচ্ছে। এটা আবেগি রাজনীতির বিপরিতে ভালো উদাহরণ নিঃসন্দেহে। এবার এই উদাহরণের স্বীকৃতি দেওয়া হোক দলীয়ভাবে, বাস্তবতার প্রতিষ্ঠা হোক আনুষ্ঠানিক ভাবে!

এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

বিজ্ঞাপন

একাদশ জাতীয় নির্বাচনখালেদা-তারেকজিয়া পরিবারবিএনপি