ইতিহাস মতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল জাসদ। এই দলটির জন্ম হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালের ৩১ আক্টোবর। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১০ মাসের মাথায় জাসদ নামের তারুণ্যময় রাজনৈতিক দলটি আত্মপ্রকাশ করে। জাসদের আত্মপ্রকাশের ঘটনা কারো অজানা নয়। বহুদিন ধরেই এ সম্পর্কিত নানা ধরনের আলোচনাও চলমান রয়েছে। ইতিহাস বলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর কাছে দেশ পরিচালনার পদ্ধতিগত কিছু আলোচনা উত্থাপন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাঝে মেধাবী প্রগতিশীল বলে পরিচিত অংশটি। যারা মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় অসম সাহসী সংগঠক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাত্বিক সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে এই অংশই একাত্তরের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে দেশ পরিচালনার জন্যে ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠনের প্রস্তাবনা হাজির করেন। বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাখে মতদ্বৈততা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
৭২ সালের ২৩ জুলাই ছাত্রলীগের দুই অংশ আলাদা আলাদা সম্মেলন হয়। দুই ছাত্রলীগই বঙ্গবন্ধুকে তাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রব-শাজাহান সিরাজের অংশকে বাদ দিয়ে মাখন-সিদ্দীকির নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের সম্মেলনে গিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। ছাত্রলীগের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষাদিবস উপলক্ষ্যে পল্টনে অনুষ্ঠিত সভা থেকে নতুন দল গঠনের ইঙ্গিত দেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ডাকুসর প্রথম নির্বাচিত ভিপি আসম আব্দুর রব। অতঃপর ৩১ অক্টোবর নয় নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জলিল এবং আসম রবকে যুগ্ম আহবায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করে নতুন রাজনৈতিক দল জাসদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কমিটিতে অন্যান্যদের মধ্যে থাকেন তুখোড় ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ, নুরআলম জিকু, শ্রী বিধান কৃষ্ণ সেন, মোহাম্মদ রহমত আলী এবং সুলতান উদ্দিন আহমেদ। মো. রহমত আলী অবশ্য দ্রুতই নিজেকে জাসদ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন। ৭৩ সালের ১৪ জানুয়ারি জাসদ যে দলীয় ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে সেখানে মুখবন্ধের প্রথম প্যারার শেষ অংশে নতুন দলের অত্মপ্রকাশ সম্পর্কে লেখা হয়-সংগ্রামী জনতার বিক্ষুব্ধ মনের বহিঃপ্রকাশকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এ দেশের আপামর কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল।
জাসদের রাজনীতি নিয়ে অনেক ধরনের তর্ক-বিতর্ক চলমান। রাজনীতির বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেই বিতর্ক কখনও কখনও নতুন নতুন উত্তাপও তৈরি করে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসনামলে সশস্ত্র গণবাহিনীগঠন, ৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি, ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার অভূত্থানে জাসদের নেতৃত্ব দেওয়া, কর্ণেল আবু তাহেরকে মুক্ত করতে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের অপহরণের ঘটনা, উপর্যপুরি দল ভাঙ্গনের শিকার হওয়া-এ সব ঘটনা ও প্রশ্ন এখনও জাসদকে ভীষণরকম তাড়া করে। জনসমর্থনের বিচারে রাজনীতিতে জাসদ অনেক পিছিয়ে থাকলেও আলোচনায় জাসদ কখনই পিছিয়ে আছে বলে মনে হয়নি। কখনই কখনই জাসদ ভীষণরকম অপ্রপ্রচারেরও শিকার হয়েছে।
৭২-এ জাসদ গঠিত হয়েছিল মূলত যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দেওয়া এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই। বিশেষ করে বিএলএফ-এর একটি বড় অংশই ছিল জাসদের পতাকাতলে। আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকে গঠিত হওয়ার পরপরই এই দলটি ক্ষমতায় থাকা খোদ আওয়ামী লীগেরই বিরুদ্ধে রাজপথে সবচেয়ে সোচ্চার ও সাহসী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরবর্তীতে সামরিক সরকার জিয়া এবং এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধেও জাসদ রাজপথে সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। সবসময়ই সমস্ত রক্ষচক্ষুকে উপেক্ষা করে জাসদের নেতা-কর্মীরা আন্দোলন- লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। আর তাই এই দলটির জন্যে অজস্র নেতাকর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কর্ণেল আবু তাহের, সিদ্দিক মাস্টার, মোশাররফ হোসেন, জাফর-জয়নাল, শাজাহান সিরাজ, মুন্না, ডা. মিলনসহ আরও অজস্র সমাজ বদলের স্বাপ্নিক মানুষে ও টগবগে তরুণের রক্তেই সিক্ত হয়েছে এই দলটি।
তবে জাসদ বারবারই বিধ্বস্ত হয়েছে উপর্যুপরি ভাঙ্গনের শিকার হয়ে। জাসদ গঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত যেমন একাধিবার ভাঙ্গনের মুখোমুখি তেমনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং তৃণমূল খেকে অনেক জনপ্রিয় ও সাহসী নেতা স্বইচ্ছায়ও দল ত্যাগ করেন।
জাসদ প্রথম ভাঙ্গনের মুখোমুখি হয় ৮০ সালে। মাত্র আটবছরের মাথায় আফম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আক্তারুজ্জামানের নেতৃত্বে জাসদ থেকে ছাত্রলীগের একটি বড় গ্রুপ বেরিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) গঠন করে। এই ভাঙ্গনের ফলে জাসদ বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিশেষ করে জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে সাংগঠনিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় ভাঙ্গনটা হয় ১৯৮৪ সালে। স্বৈরচারী সরকার এরশাদের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে কেন্দ্র করে জাসদ দ্বিধাবিভক্ত হয়। আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বে গঠিত হয় আলাদা জাসদ। এদিকে মীর্জা সুলতান রাজা, শাজাহান সিরাজ এবং হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে মূল জাসদ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। কিন্তু ৮৬ সালে এরশাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আবার জাসদ ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার বৈধতা তুলে একটি ছোট গ্রুপ নিয়ে আলাদা জাসদ গঠন করেন শাজাহান সিরাজ। এমন প্রেক্ষিতে মূলধারার জাসদের শ্রোতধারায় থাকেন কাজী আরেফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ। এই শ্রোতধারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে সাহসী ও আপোষহীন ভূমিকা রেখে তরুণদের মাঝে বেশ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। নব্বই দশকে জাসদ থেকে পদত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় নেতা বিধান কৃষ্ণ সেন, রওশন জাহান সাথীসহ কয়েকজন নেতা। তারা কর্মী-সমর্থক নিয়ে সরাসরি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে জাসদ নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক বিতর্ক এবং অপপ্রচার অনেকেরই প্রিয় বিষয়। কতিপয় সাবেক জাসদ নেতা-কর্মীও যারা এখন আর কোনোভাবেই দলের সাথে সম্পৃক্ত নন- তাদের অনেকেই আছেন সেই উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের সক্রিয় অংশীদার। আর তাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের চল্লিশ বছর পর জাসদ এবং কর্ণেল তাহেরের চরিত্র হনন ও কালিমালেপনে দু একজন লেখক বেশ যুৎসই ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশেষ করে সাবেক গণবাহিনী নেতা থেকে লেখক-গবেষক হওয়া এবং কিছু বিএনপিপন্থী বা জামাতি চেতনায় আশ্রয়ী কলামিস্ট এ ক্ষেত্রে বেশ বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছেন। সেটার নেপথ্যে কারণও আছে। কারণটা হলো-আওয়ামী লীগের সাথে বর্তমানে জাসদের যে রাজনৈতিক মিত্রতা সেটা অনেকেই সুনজরে দেখেন না। এ কারণেই আওয়ামী বিরোধী লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ সুকৌশলে বারবার জাসদকে নিয়ে বিতর্কের ঢেউ ছড়িয়ে দেন।
জাসদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের শেষ নেই। তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একতরফা আলোচনা বরাবরই সত্যকে আড়ালে ঢেকে ফেলে। জাসদকে নিয়ে সেই ধারাবাহিকতা চলমান বললে ভুল হবে না। বিশেষ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জাসদ আওয়ামী লীগের সাথে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার পরপরই জাসদকে নিয়ে নতুন নতুন বিতর্ক তৈরি করা হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৪ দলীয় জোট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। জাসদের দিক থেকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্যের কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১.বিএনপি-জামাত এবং এদের মিত্র জঙ্গীবাদী- মৌলবাদী-উগ্রবাদী-সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে রাখা, ২. বিএনপি-জামাত এবং এদের মিত্র জঙ্গীবাদী-মৌলবাদী-উগ্রবাদী-সন্ত্রাসবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ৩.রাষ্ট্র-সংবিধান-রাজনীতি-সমাজ অঙ্গণ থেকে সামরিক শাসকদের রেখে যাওয়া জঞ্জাল পরিস্কার করা। এ রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই জাসদ রাজনৈতিক ঐক্যের নীতি প্রণয়ন করেছে, ঐক্যের জন্য উদ্যোগী হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত ঐক্য চর্চা করছে।
রাজনীতির ময়দানে জাসদকে নিয়ে যতো বিতর্ক আছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হোক, নির্মোহ আলোচনা হোক-আপত্তি নেই। তবে অল্পকথায় বুঝি জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী না হলে, জাসদ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতার সহযোগী ও অংশীদার না হলে জাসদকে নিয়ে বোধ হয় কেউ বিতর্ক তুলতেন না। জাসদ ক্ষমতার বাইরে বা ভেতরে যেখানেই থাকুক তার পথ চলা বরাবরই কণ্টকময়, কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
বিজ্ঞাপন