ঘাড়ে ব্যথা বা নেক পেইন

আমাদের বেশীরভাগ মানুষই জীবনের কোনো এক সময় ঘাড়ে ব্যথায় ভোগেন। মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশকে মেডিকেল ভাষায় সারভাইক্যাল স্পাইন বলে।

মেরুদণ্ডের উপরের সাতটি কশেরুকা ও দুই কশেরুকার মাঝখানের ডিস্ক, পেশী ও লিগামেন্ট নিয়ে সারভাইক্যাল স্পাইন বা ঘাড় গঠিত। মাথার হাড় (স্কাল) থেকে মেরুদণ্ডের সপ্তম কশেরুকা পর্যন্ত ঘাড় বিস্তৃত। আট জোড়া সারভাইক্যাল স্পাইন নার্ভ (স্নায়ু) ঘাড়, কাঁধ, বাহু, নিুবাহু এবং হাত ও আঙ্গুলের চামড়ার অনুভূতি ও পেশীর মুভমেন্ট প্রদান করে। এ জন্য ঘাড়ের সমস্যায় রোগী ঘাড়, কাঁধ, বাহু ও হাত বা শুধু হাতের বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ঘাড়ের সমস্যা পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি হয়।

ঘাড়ে দুই ধরনের ব্যথা হয়। লোকাল বা স্থানীয় ব্যথা এবং রেফার্ড পেইন বা দুরে ছড়িয়ে যাওয়া ব্যথা। 

ঘাড় ব্যথার কারণ:
অনেকগুলি কারণে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে, তার মধ্যে সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস, সারভাইক্যাল স্পনডাইলাইটিস, সারভাইক্যাল স্পনডাইলিসথেসিস,সারভাইক্যাল রিবস, সারভাইক্যাল ক্যানেল স্টেনোসিস বা স্পাইনাল ক্যানাল সরু হওয়া, সারভাইক্যাল ডিক্স প্রলেপস বা হারনিয়েশন যেখানে হারনিয়াটেড ডিস্ক নার্ভ এর উপর চাপ প্রয়োগ করে, মাংসপেশী, হাড়, জোড়া, লিগামেন্ট, ডিস্ক (দুই কশেরুকার মাঝখানে থাকে) ও স্নায়ুর রোগ বা ইনজুরি।

অস্বাভাবিক পজিশনে নিদ্রা বা অনিদ্রা;উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ, হাড় ও তরুণাস্থির প্রদাহ এবং ক্ষয়, অস্টিওপরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় ও ভঙ্গুরতা রোগ,হাড় নরম ও বাঁকা হওয়া,রিউমাটয়েড-আর্থ্রাইটিস ও সেরো নেগেটিভ আর্থ্রাইটিস,সারভাইক্যাল অস্টিও-আর্থ্রাইটিস ফাইব্রোমায়ালজিয়া,সামনে ঝুঁকে বা পাশে কাৎ হয়ে ভারী কিছু তুলতে চেষ্টা করা, হাড়ের ইনফেকশন,ডিস্কাইটিস (ডিস্কের প্রদাহ), পেশাগত কারণে দীর্ঘক্ষণ ঘাড় নিচু বা উঁচু করে রাখলে যেমন ডেস্কে বসে কাজ করা, কম্পিউটার নিয়ে কাজ করা, টেলিফোন অপারেটর ইত্যাদি।

এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ারে বসে পড়াশোনা করার সময় ঘাড় ও মাথার অবস্থান ঠিকমতো না হলে উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়লে, ড্রাইভিং করার সময় ঘাড় ও মাথা সঠিকভাবে না থাকলে, বুক ও পেট মধ্যকার বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যার জন্য (যেমন, পিত্তথলির পাথর, ডায়াফ্রাম ইরিটেশন ইত্যাদি) ঘাড় ব্যথা হতে পারে। একে রেফার্ড পেইন বলে।
ঘাড় ব্যথার হলে যে সম্যসা দেখা দেয়:
ঘাড় ব্যথা এবং এই ব্যথা কাঁধ, বাহু, হাত ও আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে,কাঁধ, বাহু, হাত ও আঙুলে অস্বাভাবিক অনুভূতি বা অবশ ভাব, বাহু, হাত ও আঙুল দুর্বল হতে পারে সব সময় ঘাড় ধরে বা জমে (স্টিফনেস) আছে এবং আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে,ঘাড়ের মুভমেন্ট ও দাঁড়ানো অবস্থায় কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যায়,হাঁচি, কাশি দিলে বা সামনে ঝুঁকলে ব্যথা বেড়ে যায়, ব্যথা মাথার পেছন থেকে শুরু হয়ে মাথার সামনে আসতে পারে,শরীরে অসহ্য দুর্বলতা লাগে, ঘুমের বিঘ্ন এবং কাজ করতে অক্ষমতা লাগে, শারীরিক ভারসাম্য হারাবে প্রসাব ও পায়খানার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হবে।

এছাড়া রাতে বেশি ব্যথা হলে বা ব্যথার জন্য ঘুম ভেঙে যায়, ব্যথার সঙ্গে জ্বর, ঘাম, শীত শীত ভাব বা শরীর কাঁপানো ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

ঘাড় ব্যথার ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা: ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা প্রদানের আগে কারণ নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করতে হবে। রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা,এক্স-রে,এমআরআই,সিটি স্ক্যান ইত্যাদি। bold;”>চিকিৎসা :
ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা এর কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হল
;
১. ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ নিরাময় করা এবং
২. ঘাড়ের মুভমেন্ট স্বাভাবিক করা।

কনজারভেটিভ চিকিৎসা:
১. এন্টিইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ সেবন
২. ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা – এটিই পাশ্ব প্রতিক্রিয়াবিহীন আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, বিভিন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে। এখানে বিভিন্ন ম্যানুয়াল বাম্যানুপুলেশন থেরাপি, থেরাপিউটিক  এক্সারসাইজ এবং এই চিকিৎসাই ব্যবহৃত হয়।  বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রোমেডিকেল ইকুপমেন্ট যেমন- ইন্টারফ্যারেনশিয়াল থেরাপি, অতি লোহিত রশ্মি, মাইক্রো-অয়েভ ডায়াথারমি, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি ও ইন্টারমিটেন্ট ট্র্যাকশন, ট্রানসকিউটেনিয়াস ইলেকাট্রক্যাল সিাটমুলেশন ইত্যাদি। কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে ২-৩ সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সম্পুর্ণ বিশ্রামে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়।
সার্জিক্যাল চিকিৎসা:
কনজারভেটিভ বা মেডিকেল চিকিৎসায় ভালো না হলে, ব্যথা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে, স্নায়ু সমস্যা দেখা দিলে, বাহু, হাত ও আঙুলে দুর্বলতা এবং অবশ ভাব দেখা দিলে এবং প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে দ্রুত সার্জিক্যাল চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল চিকিৎসা কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে।

ঘাড় ব্যাথা থেকে যেভাবে রক্ষা পাওয়া যায়:
১. সামনের দিকে  ঝুকে দীর্ঘক্ষন কাজ করবেন না।
২. মাথার উপর কোনো ওজন নিবেন না।
৩. প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে হবে। 
৪. শক্ত বিছানায় ঘুমাবেন। 

৫. শোবার সময় ১টা মধ্যম সাইজের বালিশ ব্যবহার করবেন যার অর্ধেকটুকু মাথা ও অর্ধেকটুকু ঘাড়ের নিচে দিবেন।
৬. তীব্র ব্যথা কমে গেলেও ঘাড় নিচু বা উঁচু করা, মোচড়ানো (টুইসটিং) পজিশন বন্ধ করা।
৭. অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বন্ধ করতে হবে।
৮. সেলুনে কখনই ঘাড় মটকাবেন না।
৯. কাত হয়ে শুয়ে দীর্ঘক্ষণ পড়বেন না বা টেলিভিশন দেখবেন না। 
১০. কম্পিউটারে কাজ করার সময় মনিটর চোখের লেভেলে রাখবেন।
১১. গরম প্যাড, গরম পানির বোতল দিয়ে গরম সেঁক দিবেন।
১২. ঘাড়ের পেশী নমনীয় ও শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়াম করতে হবে।
১৩. ভ্রমণের সময় গলায় সার্ভাইক্যাল কলার ব্যবহার করবেন।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য কথা