কোভিড-১৯: প্রশ্ন অনেক, উত্তর অজানা

নিজেদের কিটের একটি অংশের ‘আশানুরূপ ফল’ পাচ্ছে না গণস্বাস্থ্য- এই সংবাদ শিরোনামে আমরা যারপর নাই আশ্চর্যান্বিত হয়েছি, লজ্জিতও। কেননা গণস্বাস্থ্যের গবেষকদের উপর আমাদের অনেক আস্থা ছিলো। ছিলো শর্তহীন সমর্থন এবং অগ্রিম অভিনন্দন। গবেষণার সন্তোষজনক ফলাফলের দাবি ছিলো, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। এখন সব কিছুই প্রশ্নবিদ্ধ? গণস্বাস্থ্য কিসের ভিত্তিতে ওষুধ প্রশাসনে অনুমোদনের আবেদন করেছিলেন? ওষুধ প্রশাসনই বা কিসের ভিত্তিতে তুলনামুলক নিরীক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন? প্রশ্ন অনেক? তবে উত্তর অত্যন্ত সরল। কারো দায়বদ্ধতা নাই- কর্মক্ষেত্রেও না, নিজের বিবেকের কাছেও না।

গণস্বাস্থ্যের এই কিট-বিতর্ক প্রায় ৩ মাসের। এই তিন মাসের মধ্যে কেউ আমাদের গণস্বাস্থ্যের রেপিড টেস্ট কিটের বৈজ্ঞানিক রহস্যের ব্যাখ্যা দেয় নাই- না ওষুধ প্রশাসন না গণস্বাস্থ্য নিজে। এতো গোপনীয়তার কি কারণ ছিলো- মৌলিক গবেষণা? নাকি নতুন কিছু আবিষ্কার বা উদ্ভাবন? নাকি একটি রেপিড ডায়াগনস্টিক টেস্ট কিট তৈরি করে সবার আগে বানিজ্যকরণ? না কি শুধুই চমক, এক পরীক্ষায় এন্টিজেন এবং এন্টিবডি উভয়ই শনাক্তকরনের সাফল্য? দেশজুড়ে বিতর্ক আর নেতিবাচক সমালোচনায় বিদ্ধ সরকার। যেনো আমরা বিরাট এক আবিস্কারের মেধাস্বত্ব এবং বিশ্বজুড়ে বানিজ্যকরণের সুযোগ হাতছাড়া করতে যাচ্ছি।

অনেকে আবার এর পিছনে রাজনৈতিক প্রশয়ের সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন। আবার অনেকেই আইনের, অজ্ঞতার এবং নৈতিকতার প্রশ্নও সামনে এনেছে? অনেক বিতর্ক, অনেকের অংশ গ্রহণে অনেক প্রানবন্ত ছিলো মিডিয়া জগত। হঠাৎ করেই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির সাফল্যের ঢেউয়ে এই বিতর্ক স্তিমিত হয়ে পড়ে। আবার শিরোনামে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিট- নিজেদের উদ্ভাবিত কিটে করোনার নমুনা পরীক্ষায় অ্যান্টিজেনের ফলাফল আশানরূপ না পেয়ে ওই অংশের পরীক্ষা আপাতত স্থগিত রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএসএমএমইউ) চিঠি দিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

বিতর্ক কেনো এতদূর গড়াবে? আমাদের কি সক্ষমতা ছিলো না – মার্চেই এই বিতর্ক শেষ করার। বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তুলনামুলক পুনঃনিরীক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। পুনঃনিরীক্ষণ বলার কারণ- গণস্বাস্থ্য সবসময়ই বলে আসছে প্রায় ১০০ ভাগ কার্যকরী এবং এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণাদি থাকার সাপেক্ষেই কেবল মাত্র বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন নিরীক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাঠাতে পারে। অন্যথায় নয়?

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীতে এন্টিজেন শনাক্তকরণের মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের যৌক্তিকতা কি? এর পক্ষে গণস্বাস্থ্যের গবেষকদের কি যুক্তি আছে? বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনেরই বা কি যুক্তি? আশা করি, এফডিএ-এর ন্যায় বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনে এই এন্টিজেন শনাক্তকরণের টেস্ট ব্যবহারের বিশদ নির্দেশনা থাকবে। অন্যথায় অপব্যবহার নিশ্চিত।

ইতিপূর্বে এই জাতীয় ভারাইসজনিত রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এন্টিজেন শনাক্তকরনের পরীক্ষার কোনো ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায় নাই। কোনো ক্ষেত্রে এই এন্টিজেন শনাক্তকরণের পরীক্ষার সংবেদনশীলতা বা সেন্সিটিভিটি (Sensitivity) মলিক্যুলার পিসিআর (RT-PCR) এর তুলনায় শতকরা ৩৮ ভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন গবেষণাতেও এই এন্টিজেন শনাক্তকরনের আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া যায় নাই। অধিক সংখ্যক নেতিবাচক (False Negative) ফলাফল নিরবে বহু সংখ্যক সংক্রমণ হবার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি হবে। সেইহেতু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয়ে এন্টিজেন শনাক্তকরণের রেপিড টেস্ট কিট ব্যবহারে নির্দিষ্টভাবে অনুৎসাহিত করেছে (Poor Clinical Sensitivity of Rapid Antigen Test for Influenza A Pandemic (H1N1), www.cdc.gov/eid Vol. 15, No. 10, October 2009; WHO Scientific Brief, 8 April 2020)। স্বভাবতই এন্টিজেন শনাক্তকরনের টেস্ট উন্নয়নে বা উদ্ভাবনে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর আগ্রহ অত্যন্ত কম। এফডিএ অনুমোদিত একমাত্র এন্টিজেন শনাক্তকরনের টেস্টের অনুমোদনে স্পষ্ট করে নির্দেশনা দেওয়া আছে – এইরূপ পরীক্ষা পদ্ধতি সকল কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয়ে সক্ষম নয় এবং মলিক্যুলার পিসিআর (RT-PCR) মতন সংবেদনশীলও নয়। সেইহেতু, এই পরীক্ষার নেতিবাচক বা নেগেটিভ ফলাফল পুনরায় মলিক্যুলার পিসিআর(RT-PCR)-এর মাধ্যমে সত্যায়ন করতে হবে(সুত্রঃ May 09, 2020 Statement From: Commissioner of Food and Drugs)।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কার্যকর আইনি সুরক্ষা না থাকায়, অনেক চিকিৎসা ব্যবস্থার অপব্যবহার হয়। ওষুধের অপব্যবহার উল্লেখ করার মতন। আমাদের দেশ অত্যন্ত জনবহুল, সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তারের ভয়াবহ ঝুঁকি সবসময়ই থেকে যায়। এখনো কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ উর্ধ হারে বাড়ছে। এই মুহূর্তে এন্টিজেন শনাক্তকরণের টেস্ট অনুমোদনের জন্য আরো অধিক পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা প্রয়োজন। তবে এন্টিবডি নির্ণয়ের জন্য প্রচলিত বা রেপিড টেস্ট কিট এই মুহূর্তে জরুরী? কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির জন্য এন্টিবডি পরিমান নির্ণয় অত্যবশ্যকীয়। সঠিক পরিমান এন্টিবডির উপস্থিতি নিশ্চিত না করে কনভালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহারে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া নাও যেতে পারে। এই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- কনভালেসেন্ট প্লাজমায় উপস্থিত এন্টিবডি দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ভাইরাসের কার্যক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করা। এই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি দ্বারা আরো নিশ্চিত ফলাফলের জন্য এন্টিবডি পরিমান নির্ণয়ের পাশাপাশি ভাইরাস নিস্ক্রিয়করন পরীক্ষা (Virus Neutralization Assay) করা যেতে পারে। অনেক সময় কনভালেসেন্ট প্লাজমায় উপস্থিত এন্টিবডির রোগীর দেহের ভাইরাসের কার্যক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করার সক্ষমতা নাও থাকতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপির ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়।

আমরা কোভিড১৯ রোগ প্রতিরোধের কার্যকরী সমন্বিত প্রয়াস আশা করি। সকল বিভাগের সমন্বিত চেষ্টাতেই আমাদের মুক্তি। প্রশাসনের কোনো সীমাবদ্ধতা থাকে না, সীমাবদ্ধতা থাকে প্রশাসকের জ্ঞানের, প্রজ্ঞার আর মানবিকতার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসকোভিড-১৯গণস্বাস্থ্যবৈশ্বিক মহামারী