এখনও বাতাসে ভাসে কামান্নার ২৭ শহীদের কান্না

আজ ২৬ নভেম্বর। কামান্না ট্র্যাজেডি দিবস। এই দিনটি মাগুরা ও ঝিনাইদহবাসীর জন্য ভীষণরকম শোকাবহ এক দিন। এদিনটি এলেই মাগুরা ও ঝিনাইদতে শোক আর বেদনা বড়বেশি অনুভূত হয়। একাত্তরের এদিন ঘন কুয়াশাচ্ছিদ ভোরে পাক হানাদাররা ভারি অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানার কামান্না গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে হামলা চালালে কামান্নার মাটি ২৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদেও সবাই ছিলেন সাধারণ পরিবারের সন্তান।

শহীদ ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধার বেশিরভাগের বাড়িই ছিল তৎকালীন মাগুরা মহকুমার সদর থানার হাজীপুর ইউনিয়নের হাজীপুর, শ্রীমন্তপুর, আরালিয়া, হ্নদয়পুর, ফুলবাড়িসহ বিভিন্ন গ্রামে। কামান্না যুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সবাইই ছিলেন স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হাজীপুরবাহিনী, আকবারবাহিনী এবং বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপের সদস্য।

যুদ্ধে মোট ৪২ থেকে ৪৫ জন যোদ্ধা সরাসরি আক্রান্ত হন। এই যুদ্ধের মূল অবস্থান থেকে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা সামাদ (এফএফ), এসএম রহমান (এফএফ), বাঁশি, আব্দুস সালাম, লিয়াকত (বড়), লিয়াকত (ছোট), সমেশ চন্দ্র দে (এফএফ), আতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, মোল্লা ওসমান, আব্দুল জলিল (পুলিশ), আব্দুল আজিজ।

ভোরে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনীর নির্মম হামলায় আরও শহীদ হন কামান্না গ্রামের বাসিন্দা ফণীভূষণ মজুমদার এবং রঙ্গ বিবি। এই যুদ্ধে ২৭ শহীদের ২৬ জনই কামান্নাতে মাধবচন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের স্পট ক্যাম্পেই শহীদ হন। শুধুমাত্র গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক রাজা (এফএফ) একদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন। পরে দাইরপোল নিজবাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।

কামান্না যুদ্ধে যে ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তারা হলেন-শহীদ আব্দুল মোমিন উদ্দীন (ফুলবাড়ি, মাগুরা), শহীদ মো. কাদের বিশ্বাস (মোর্তোজাপুর, শ্রীপুর), শহীদ মো. শহীদুল ইসলাম (পশ্চিম বেরেইলা, মাগুরা), শহীদ মো. ওয়াহিদুজ্জামান (ফুলবাড়ি, মাগুরা), শহীদ রিয়াত মন্ডল (আলীধানী, মাগুরা), শহীদ আব্দুল মোতালেব (ইছাখাদা, মাগুরা), শহীদ আলী হোসেন (আরালিয়া, মাগুরা), শহীদ শরিফুল ইসলাম (কালালক্ষীপুর, ঝিনেদা), শহীদ মুন্সী আলীমুজ্জামান ওরফে আরিফ মুন্সী (বিষ্ণুপুর, মাগুরা), শহীদ মো. গোলাম কওসার মোল্লা (মির্জাপুর, মাগুরা), শহীদ মনিরুজ্জামান খান ওরফে মনি খাঁ ( হ্নদয়পুর, মাগুরা), শহীদ সেলিম ওরফে কেটে (শিবরামপুর, মাগুরা), শহীদ হোসেন আলী ( শ্রীমন্তপুর, মাগুরা), শহীদ রাশেদ হোসেন (শিবরামপুর, মাগুরা), শহীদ গোলজার খাঁ (মালিগ্রাম, মাগুরা), শহীদ আনিসুর রহমান (আরিয়াকান্দি, মাগুরা), শহীদ অধীর কুমার শিকদার (হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ তাজুল ইসলাম তাজু (পারনান্দুয়ারী ব্যাপারীপাড়া), শহীদ গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ আলমগীর ( হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রাজা (দাইরপুল, মাগুরা), শহীদ আকবর (অজ্ঞাত), শহীদ সালেক মোল্লা (দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), শহীদ সলেমান শিকদার (নরসিংহাটি, মঘি, মাগুরা), শহীদ মাছিম মিয়া (হ্নদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ মুন্সী আব্দুর রাজ্জাক রাজা (বারইপাড়া, শ্রীকোল, মাগুরা), শহীদ নিখিল কুমার মন্ডল (বাগডাঙ্গা, মাগুরা)।

এই যুদ্ধের বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানা যায়, ২৪ নভেম্বর মাগুরা সদর থানার হাজীপুর এলাকা থেকে হাজীপুরের বাসিন্দা সেনাবাহিনীর হাবিলদার মেজর বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের আলীর নেতৃত্বে ‘হাজীপুর বাহিনী’র একটি গ্রুপ নিয়ে পাশের গ্রাম লক্ষীকোল, বরইচারা হয়ে আড়াআড়ি কয়েক মাইল কাদাপানি পথ পাড়ি দিয়ে প্রথমে শৈলকূপার ফাদিলপুর বাজারে অবস্থান নেন। ওখান থেকে মুক্তিযোদ্ধা দলটি কুমার নদী পার হয়ে কামান্নাতে আসে।

এরপর কামান্না স্কুলের পাশেই মাধবচন্দ্র ভৌমিকের ফেলে যাওয়া বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করে হাজীপুরবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা দলটি। এদিকে সংকেত পেয়ে এই বাহিনীর সাথে মাগুরা সদর থানার ধনেশ্বরগাতি ইউনিয়নের গজদুর্বা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই চৌধুরীর (ফুলবাড়ি) নেতৃত্বে অবস্থানরতম অন্তত ৩টি গেরিলা দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এফএফ বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটা পথে এসে কামান্নাতে মিলিত হন।

৩টি গেরিলা দলের নেতৃত্বে থাকেন এমএ সামাদ (বরিশাট), মুক্তিযোদ্ধা এসএম আব্দুর রহমান (হাজীপুর) এবং অধীর কুমার শিকদার (হাজীপুর)। গেরিলাদের মধ্যে উপস্থিত থাকেন আব্দুস সালাম (ইছাখাদা), মো. আব্দুর রাজ্জাক রাজা ( দাইরপোল) আনিসুর রহমান (আরিয়াকান্দি), লিয়াকত হোসেন ( বাখড়া মোর্দ্দমকোলা) লিয়াকত হোসেন (পল্টন লাইন, ঢাকা)।

অন্যদিকে অধীর কুমার শিকদারের নেতৃত্বে গেরিলা দলে ছিলেন ডেপুটি কামান্ডার সমেশ চন্দ্র দে (শ্রীকুন্ঠী), তাজুল ইসলাম তাজু (পারনান্দুয়ারী ব্যাপারীপাড়া), গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর), আতিয়ার রহমান (পারনান্দুয়ারী ব্যাপারীপাড়া), চিত্ররঞ্জন বসু ( পশ্চিম বেরেইলা), সুনীতি বিশ্বাস (আড়াইশত)।

মুক্তিযোদ্ধা দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল কামান্নার অস্থায়ী ক্যাম্পে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাক হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের কর্মকৌশল ঠিক করা এবং হাজীপুর, ইছাখাদা থেকে রাজাকার নির্মূল করা। এদিকে ওইদিনই আব্দুর রউফ-এর নেতৃত্বে বিএলএফ-এর একটি যোদ্ধা দলও হাজীপুর থেকে এই পাশের পদ্মনগর, যুগনি গ্রাম হয়ে ঐ ক্যাম্পে যোগ দিতে আসে। কিন্তু খাবার নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় তারা রাতেই ফিরে অন্যত্র চলে যায়।

এদিকে দ্রুতই কামান্নাতে এই মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর অবস্থান ঝিনাইদহে অবস্থানরত পাকসেনাদের কাছে ফাঁস করে দেয় স্থানীয় রাজাকাররা। অতঃপর ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনী ২৬ নভেম্বর ভোররাতে শৈলকূপার দিক থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নেওয়া টিনের ঘরটি ঘিরে ফেলে। এ সময় পাহারারত দুএকজন ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই ঘুমিয়েছিলেন। গেরিলা কিশোর যোদ্ধা বাঁশি প্রাকৃতিক কাজ সারতে বাইরে এলে বুটের শব্দ পান।

তিনি চিৎকার দিয়ে সবাইকে প্রতিরোধের কথা বলেন। মুহূর্তেই ঘন কুয়াশার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার ওপেন করে পাকহানাদাররা। ঘুম থেকে তড়িৎ উঠে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সামাদ, রহমান, আলী হোসেন, জলিল, মোতালেব, গুলজার, ওসমান সর্বাত্বক চেষ্টা করেন পাকহানাদারদের প্রতিরোধ করতে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্র আর অতর্কিত হামলার কারণে সেটা সম্ভব হয়ে উঠে না। হানাদাররা ঘরে ঢুকেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি করে হত্যা করেন।

ফলে মাধব চন্দ্র ভৌমিকের বাড়ির উঠানেই শহীদ হন ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মূল অবস্থান থেকে সরে নদীর দিকে চলে যান। বেঁচে থাকা এবং আহত হওয়া অন্যান্য যোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়েন। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর স্থানীয় গ্রামবাসী এসে লাশগুলো উদ্ধার করে পাশেই কামান্না স্কুল সংলগ্ন এলাকায় ২৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার গণকবরের ব্যবস্থা করেন। গুরুতর আহত আব্দুর রাজ্জাক রাজা দুদিন পর মারা যান। তাকে শ্রীপুর দাইরপোলে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।

কামান্নার যুদ্ধে ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও মাগুরাতে এই শহীদদের স্মরণে কোনো স্মৃতি স্মারক গড়ে তোলা হয়নি। ফলে নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগই এই যুদ্ধ এবং শহীদদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। আর তাই বিস্মৃত হতে চলেছে কামান্নার ২৭ শহীদের নাম। এ নিয়ে কামান্নার রনাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর ক্ষোভের অন্ত নেই। এদিকে এই যুৃদ্ধে শহীদ কওসার, মাছিম মিয়া, মণিখাঁ, কাদের, সালেক, সলেমান, গুলজারের পরিবার অভাবগ্রস্থ অবস্থায় নিদারুণ কষ্টে থাকলেও দেখার কেউ নেই।

কামান্নার রণাঙ্গনে যে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাদের পরিবার, উত্তরাধিকাররা কেমন আছে তা সরেজমিনে দেখতে শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজে আমরা দিনের পর দিন গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটেছি। হাজীপুর, শ্রীমন্তপুর, আরালিয়া, হ্ন্দয়পুর, পারনান্দুয়ালী, বেষ্টপুর, দাইরপোল, ইছাখাদা, মালিগ্রাম, নরসিংহহাটি, বারইপাড়া, মর্তোজাপুর, দ্বারিয়াপুর, মির্জাপুরসহ আরো অনেক গ্রামে গিয়েছি শহীদ পরিবারগুলোর অবস্থা সরেজমিনে দেখতে। শহীদ পরিবারের বেঁচে থাকা মা এবং বিভিন্ন সদস্যদের সাথে কথা বলেছি, জানতে চেষ্টা করেছি তারা কোথায় কেমন কী অবস্থায় আছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মোল্লা গোলাম কওসার ( মির্জাপুর, হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ সালেক মোল্লা ( দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), শহীদ মনিরুজ্জামান খান ওরফে মনি খাঁ (হ্নদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ আলী হোসেন (আরালিয়া, হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ সলেমান শিকদার (নরসিংহাটি, মঘি, মাগুরা ) শহীদ তাজুল ইসলাম তাজু (পারনান্দুয়ালী ব্যাপারীপাড়া, মাগুরা), শহীদ শরিফুল ইসলাম ( কালালক্ষীপুর, ঝিনেদা), শহীদ সেলিম ওরফে কেটে ( শিবরামপুর, মাগুরা), শহীদ মো. কাদের বিশ্বাস (মর্তোজাপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), শহীদ মো. ওহিদুজ্জামান (ফুলবাড়ি, হাজীপুর, মাগুরা), শহীদ আব্দুল মোতালেব ( ইছাখাদা, হাজরাপুর, মাগুরা), শহীদ গোলজার খাঁ ( মালিগ্রাম, মাগুরা), শহীদ মাছিম মিয়া ( হদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা), এবং গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর, মাগুরা)-এর পরিবার এবং উত্তরাধিকাররা সবেচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার।

মির্জাপুরে শহীদ মোল্লা গোলাম কওসার ( মির্জাপুর, হাজীপুর, মাগুরা)-এর বাড়িতে গেলে কারোরই বোধ হয় বিশ্বাস হবে না এই বাড়ির সন্তান শহীদ কওসার। পুরোনো সেই জীর্ণশীর্ণ ঘর সাক্ষ্য দিচ্ছে কতোটা অবহেলা করা হয়েছে তার শহীদি রক্তের প্রতি। যে টিনের ছাপড়া ঘর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কওসার যুদ্ধে গিয়েছিলেন ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে সেই জীর্ণশীর্ণ ঘরটি।

কওসারের উত্তরসুরী হিসেবে আছেন বড় ভাই-এর ছেলে আলীম মোল্লা এবং মেয়ে পারুল বেগম। আর্থিক অনটনে দুজনেই বিধ্বস্ত। মুক্তিযোদ্ধা চাচার জীবনের প্রতিদানে তারা কিছুই পাননি। ইপিআরের সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা শরিফুল ইসলাম ( কালালক্ষীপুর, ঝিনেদা) হাজীপুরের শ্রীমন্তপুরে বিয়ে করার সুবাদে শ্বশুরবাড়ির এলাকাতেই পাক হানাদারদের প্রতিরোধে নামেন।

কামান্নাতে শহীদ হওয়া এই যোদ্ধা মৃত্যুর আগে অন্যান্য আপনজনের সাথে রেখে যান স্ত্রী আছিয়া খাতুন এবং একমাত্র শিশু কন্যা বিউটিকে। বাবা দেশের জন্যে জীবন দিলেও বিউটির ভাগ্যের কোনা পরিবর্তন হয়নি।

শহীদ মো. কাদের বিশ্বাস (মর্তোজাপুর, শ্রীপুর, মাগুরা) ছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার আগে পরিবার-পরিজনের সাথে রেখে যান স্ত্রীর শামসুন্নাহার এবং মেয়ে তানজিলাকে। বাবার চির স্নেহবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা কন্যা তানজিলা কেবলই বেঁচে আছেন বাবার গৌরবময় স্মৃতি নিয়ে। মেয়ে তানজিলাসহ কাদেরের পরিবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সুবিধাই পাননি।

শহীদ মো. ওহিদুজ্জামান (ফুলবাড়ি, হাজীপুর, মাগুরা)-এর উত্তরসূরী হিসেবে আছেন তাঁর বড় ভাই-এর ছেলেরা। কিন্তু তাঁদের আজন্ম দুরাবস্থা এবং অমানবিক জীবনযাপন দেখে মনে হবে এই পরিবারের একজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার প্রতিদানে কী পেয়েছে। শহীদ ওহিদের ভাই-এর ছেলেরা কেউ ভ্যান চালক, কেউবা দিনমজুর। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব ( ইছাখাদা, হাজরাপুর, মাগুরা) শহীদ হওয়ার আগে রেখে যান স্ত্রীসহ তিন নাবালক সন্তান মুন্সী বাবর আলী, মুন্সী সাবুর আলী এবং একমাত্র মেয়ে মিনা খাতুন। কিন্তু মা জামেনা খাতুন অন্যত্র বিয়ে করলে এই তিন সন্তানের জীবনে নেমে আসে এক অবর্নণীয় কষ্ট। কষ্টকে জয় করে মুন্সী বাবর আলী, মুন্সী সাবুর আলী ব্যবসা করেন। কিন্তু বাবার জীবনের প্রতিদানে সরকারের সহযোগিতা পাননি সামান্যটুকুও।

শহীদ মনিরুজ্জামান খান ওরফে মনি খাঁ’র (হ্নদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা) নাম নিশানা নাই হ্দয়পুরে। বোবা মা সারাজীবনই কষ্ট করে গেছেন। মৃত্যুর আগে খেয়ে না খেয়ে তার দিন কাটলেও কেউ তার খবর রাখেনি। শেষ জীবনে তিনি ভিক্ষা করেছেন এমন কথাও শোনা গেছে। মনি খাঁর উত্তরসুরী যারা আছেন তারা শত কষ্টের মধ্যে নিপতিত। তার বোন আর ভাই-এর ছেলেমেয়েরা শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে কতোটা বঞ্চিত এবং অবহেলিত তা না দেখলে অনুমান করা অসম্ভব।

শহীদ সালেক মোল্লা ( দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা) দেশের জন্যে নিজ জীবন উৎসর্গ করলেও তাঁর পরিবারের কারোরই ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার ভাইবোনেরা শত অভাবের মধ্যে নিমজ্জিত থাকলেও কেউ কোনোদিন সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। শহীদ সালেকের ভাই কেউ দিনমজুর কেউ বা ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান।

শহীদ তাজুল ইসলাম তাজুর (পারনান্দুয়ালী ব্যাপারীপাড়া, মাগুরা) বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগেই। শহীদ তাজুর বড় ভাইও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগ্রহে ভারতে গিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। দেশের জন্যে তাজু জীবন দিলেও তাজুর পরিবারের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি।

শহীদ গোলজার খাঁ ( মালিগ্রাম, মাগুরা) পাকসেনাদের হাতে নিহত হওয়ার আগেই নিজেই নিজেকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করেছিলেন। তার মৃত্যু এখনও সহযোদ্ধাদের কাছে এক দুঃসাহসিক স্মৃতি। সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলজার খাঁর উত্তরাধিকাররা কিছুই পাননি। শহীদ সলেমান শিকদার (নরসিংহাটি, মঘি, মাগুরা ) ছিলেন পরিবারে সবার বড়। খুবই দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন তিনি। নিজস্ব উপলব্ধি থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার রক্তের বিনিময়ে তার উত্তরাধিকারদের জীবনে কোনো পরিবর্তনই আসেনি।

শহীদ মাছিম মিয়া ( হদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা) ছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। শেখ হাসিনা ৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে শহীদ মাছিম-এর মায়ের জন্যে ছোট্র একটা ঘর করে দিয়েছিল মাগুরার তৎকালীন ডিসি নুরুজ্জামান। কিন্তু শহীদ মাছিমের মা মারা যাওয়ার পর মাছিমের উত্তরসুরীদের আর কেউ খবর রাখেনি। শহীদ আলী হোসেন (আরালিয়া, হাজীপুর, মাগুরা) ছিলেন সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা।

শিক্ষিত সচেতন এই তরুণ ছিলেন সত্যিকার এক দেশপ্রেমিক। মাগুরার বিভিন্ন ফ্রন্টে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন বলে প্রকাশ। কিন্তু এই যোদ্ধাকে মোটেও মূল্যায়িত করা হয়নি। স্থানীয়রা তার নামে একটি সড়কের নামকরণের উদ্যোগ নিলেও সরকারিভাবে তা স্বীকৃত হয়নি। গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর, মাগুরা)-এর মা বাবা কেউই বেঁচে নেই। বেঁচে আছেন ভাই হরেন নাথ রায় আর বোন বিমালা রায়। মুক্তিযুদ্ধে ভাই জীবন দিলেও মুক্তিযুদ্ধের কোনো সুফল তাদের ভাগ্যে জোটেনি। আর তাই ক্ষুধা নিবৃত্তের সংগ্রামে তারা অবতীর্ণ।

শহীদ সেলিম ওরফে কেটে ( শিবরামপুর, মাগুরা) শিবরামপুর বাসীর গর্ব হলেও তার স্বীকৃতি দৃশ্যমান নয় কোথাও। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছেও মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী যোদ্ধা সেলিম অচেনা-অজানা হয়ে উঠছেন। সেলিমের পরিবারও মুক্তিযুদ্ধের কোনো সুফল পাননি। মুক্তিযোদ্ধা মো. শহীদুল ইসলাম (পশ্চিম বেরেইলা, হাজীপুর, মাগুরা) মৃত্যুর আগে স্ত্রী প্রথম সন্তান শিমুল এবং অনাগত দ্বিতীয় সন্তান পলাশকে রেখে যান। স্বামী শহীদ হওয়ার পর স্ত্রী কাজী হোসেনে আরা মীরাকে এক দুঃসহ জীবনের মুখোমুখি হন তিনি। তবে বঙ্গবন্ধুর সহযোগিতায় দুটি ছেলেকে তিনি মানুষ করতে সমর্থ হন।

৭২ সালে তৎকালীন মন্ত্রী সোহরাব হোসেনের হাত ধরে তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সাথে দেখা করার সুযোগ পান। সে সময় বঙ্গবন্ধু তাকে ১০ হাজার টাকার একটি চেক দেন। এই টাকা দিয়ে কাজী হোসেনে আরা নীরা পিতার এলাকাতে কিছু জমি কেনেন। এই জমির ওপর ভর করেই দু ছেলেকে মানুষ করেছেন তিনি। তার ছোট ছেলে বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়র। একইভাবে মোমিন উদ্দীন (ফুলবাড়ি, হাজীপুর, মাগুরা ) শহীদ হওয়ার আগে স্ত্রী এবং তিন সন্তান রেখে যান।

মোমিন উদ্দীনের স্ত্রী সরকার প্রদত্ত ভাতা পাচ্ছেন নিয়মিত। এই ভাতার ওপর ভর করেই তিনি সন্তান সন্ততি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কামান্নাতে যে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাদের মধ্যে চারজন মুক্তিযোদ্ধার মা এখনও বেঁচে আছেন। এই চার শহীদ জননী হলেন-শহীদ রিয়াত আলী মন্ডলের মা জোহরা খাতুন, শহীদ অধীর কুমার শিকদারের মা তীর্থবাসিনী শিকদার, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রাজা মিয়ার (দাইরপোল) মা রওনুক আক্তার, আব্দুর রাজ্জাক রাজার ( বারইপাড়া, শ্রীকোল, মাগুরা) মা মাসুমা খাতুন।

উল্লিখিত সবাই সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ভাতা নিয়মিত পান। কামান্নার শহীদ পরিবারের মধ্যে দুটি পরিবার এখন আর নিজ এলাকাতে নেই। শহীদ আনিসের পরিবার এখন বাস করে যশোর জেলার ঝিকরগাছাতে। নিখিল কুমার মন্ডল দেশের জন্যে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেও তার পরিবার দেশে থাকতে পারেনি। বিএনপি জমানায় শহীদ নিখিলের পরিবারকে হুমকির মুখে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হতে হয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

বিজ্ঞাপন