পাবনার সুজানগরে রবিউল নামের এক কলেজ ছাত্রকে হত্যা করেছে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মামুন। শুধু হত্যা নয়, হত্যার পর ঠাণ্ডা মাথায় নিজের শোয়ার ঘরের মাটি খুঁড়ে জানাজা পড়ে দাফন করেছে বন্ধুর লাশ। কেউ যাতে কিছু টের না পায়, সেজন্য লাশ দাফনের পর মাটি লেপে সেখানে রেখে দিয়েছে নিজের পড়ার টেবিল আর ট্রাঙ্ক। অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পুলিশ ৫৬ দিন পর মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করে নিহতের লাশ।
কিন্তু এই নৃশংসতার কারণ কী? কেনই বা সে হত্যা করলো বন্ধুকে। চ্যানেল অাই অনলাইনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে অাসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
পাবনার সুজানগর সার্কেলের সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান। ১৬ নভেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রামবাসীর সামনে মামুনের শোবার ঘর থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেসময় লাশ গলে পচে যে বিকট গন্ধের সৃষ্টি হয় তাতে আশপাশের মানুষের অবস্থান করা কষ্টের হয়ে যায়। পরে আটককৃত রবিউলের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
পুলিশ জানায়, পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের উলট গ্রামের কলেজছাত্র মামুন হোসেনে ও রবিউল। দুজনই সুজানগর উপজেলার সেলিম রেজা হাবিব ডিগ্রি কলেজের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রবিউলকে হত্যার অভিযোগে ১৭ নভেম্বর পুলিশ গ্রেপ্তার করে মামুনকে।
২০ সেপ্টেম্বর রাত ১০ টার পর থেকে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায় রবিউল। পরদিন সকালে থেকে রবিউলের বাবা ও ভাই তাকে খুঁজতে থাকেন। তবে সেদিনও ফেরেনা রবিউল। এরপর রবিউলের ভাইয়ের মুঠোফোনে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে যেখানে রবিউলকে ফিরে পেতে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অন্যথায় হত্যার হুমকি দেয়া হয়। রবিউলের পরিবার এরপর নিজেরা কিছুটা অনুসন্ধান চালিয়ে খুঁজে বের করে এসএমএস আসা নম্বরগুলোর ব্যবহারকারীদের। এর মাঝে তারা রবিউলের সবচেয়ে কাছের বন্ধু মামুনের কাছে গেলে মামুনও তাদের সাথে খুঁজতে থাকে রবিউলকে।
কোন কিনারা করতে না পেরে রবিউলের বড় ভাই ২২ সেপ্টেম্বর সুজানগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পুলিশ সেসময় এসএমএস এর সূত্র ধরে অপহরণকারী হিসেবে অাটক করে হৃদয়, শাহীন, মিঠুসহ অারও দু’জনকে। তারা পুলিশের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিলেও পরে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিতে থাকে ভিন্ন তথ্য।
বিষয়টি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠতে থাকে। এরপর পুলিশ নিহত রবিউলের ফোন ট্রেস করে জানতে পারে ঘটনার দিন ২০ সেপ্টেম্বর রবিউলের ফোনে শেষ বারের মতো এসএমএস পাঠায় মামুন। আর তারপর থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায় রবিউল। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুালিশের এসআই অসিত কুমার মামুনের খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ১০-১২ দিন আগেই গ্রাম ছেড়ে মামুন চলে গেছে ঢাকায়।
এরপর মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসএমএস এর বিষয়ে জানতে চাইলে মামুন এসআই অসিতের কাছে এসএমএসের কথা স্বীকার করে এবং সব ডিলিট করে দিয়েছে বলে জানায়।
এরপর পুলিশের নানা প্রলোভনে মামুন পাবনায় ফিরলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার জবানবন্দীতেই বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর সে রাতের কথা।
২০ সেপ্টেম্বর রাতের খাবার শেষে রবিউলকে মামুন তার বাসায় ডেকে নিয়ে যায়। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিউলকে কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো পানি খাওয়ায় সে। রবিউল ঘুমিয়ে পড়লে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মামুন।
তারপর গভীর রাতেই নিজ হাতে কবর খুঁড়ে লাশের জানাজা পড়ে মামুনকে চৌকির পাশে মেঝের মাটিতে কবর দেয়। এরপর কেউ যেনো কিছু বুঝতে না পারে সেজন্য মাটি লেপে তার ওপর নিজের পড়ার টেবিল ও ট্রাঙ্কটি রেখে দেয় সে।
এমনকি অন্যান্য রাতের মতো সে রাতেও বন্ধুকে হত্যার পর তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছে সে।
ঘটনার পর থেকেই মামুনের আচরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক বলে জানায় এলাকাবাসী ও রবিউলের পরিবার।
এরপর মামুনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৫৬ দিন পর ১৭ নভেম্বর সকালে গ্রামবাসীর সামনে মাটি খুঁড়ে পুলিশ উদ্ধার করে রবিউলের লাশ।
এ হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অসিত কুমার জানান, মামুনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ও রবিউলের ফোন ট্রেস করে জানা গেছে তারা দু’বন্ধুই একটি মেয়েকে পছন্দ করতো, তবে মেয়েটি পছন্দ করতো রবিউলকে। এর জের ধরেই ঘটে ভয়ঙ্কর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তবে বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্ত করছে পুলিশ জানিয়ে তিনি বলেন, এর পেছনে আরও অন্য কোন বিষয় রয়েছে কীনা তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।