১.
১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশে সগৌরবে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর স্মৃতি বিজড়িত এলাকায় অবস্থিত। ছায়া সুনিবীড়, শান্ত, শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠনে সহায়ক পরিবেশ, গবেষকের গবেষণাময় পরিবেশ, পাঠ্যক্রম পরিচালনার জন্য যথোপযুক্ত এবং বাংলাদেশের অনেক ইতিহাসের মহাকাব্যিক পীঠস্থানের স্মারক হিসেবে সন্তোষ এলাকাটি অত্যন্ত তাৎপর্যময়।
একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি মৌলিক ও বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ, বিকাশমানের স্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়টি শুরু থেকেই আধুনিক ও বর্তমান চ্যালেঞ্জিং বিশ্বের প্রতিযোগিতাময় অবস্থানে যথার্থতা প্রমাণে নতুন নতুন বিভাগের সমন্বয় ঘটিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ একর জায়গা প্রাকৃতিক লীলাভূমির নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য, অনন্যতা রয়েছে কাঠামো ও সামগ্রিক নান্দনিকতায়।
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের অনেক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রতিচ্ছবি বহন করে চলেছে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ বছর পদার্পণে প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করি বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন প্রতিনিয়ত সুনাম ও মর্যাদার সঙ্গে নিজস্বতা নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে।
২.
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে ৭টি বিভাগ পরিচালনা ও ছাত্র/ছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১৫টি বিভাগ চালু রয়েছে। ৫টি অনুষদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান। ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ (কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগ); লাইফ সায়েন্স অনুষদ (ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, এনভায়েরনমেন্ট সায়েন্স এবং রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ফুড টেকনোলজি এন্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিক্যুলার বায়োলজি), বিজ্ঞান অনুষদ (রসায়ন, গণিত, পদার্থ, পরিসংখান বিভাগ), ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ (ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ), সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ (অর্থনীতি বিভাগ)। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডি তে গবেষকরা উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হয়েছেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। শুরুতে ৩৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাত হাজারের উপরে।
৩.
শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা ও বোধগম্যতার জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো ও গবেষণাগারের বিকল্প নেই। শুরুর দিকে বলার মতো অবকাঠামো বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। তবে সময়ের বিবর্তনে এবং চাহিদার আলোকে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুইটি একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী, ছেলেদের জন্য তিনটি হল, মেয়েদের জন্য দুইটি হল, শিক্ষকদের ডরমেটরি, অতিথি ভবন, মেডিক্যাল সেন্টার, উপাচার্য ভবন রয়েছে এবং আরো কিছু ভবন নির্মাণাধীন।
তবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর চার তলায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ কর্নারটি এ প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বিশেষ নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নিয়ে বেশ আবেগ ও আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। দেশপ্রেমের মহিমায় প্রজ্জ্বলিত করার প্রয়াস হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ কর্নারটি অন্যতম উৎকৃষ্ট নিয়ামক। এছাড়াও, বেশকিছু উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে, প্রকল্পগুলো শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয় নতুন রূপে আবির্ভূত হবে নিঃসন্দেহে। তবে এখনো উন্নত ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ গবেষণাগার নির্মাণ সম্ভব হয়নি। আশা রাখবো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণাগার নির্মাণের ব্যাপারে দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নিয়ে গবেষণা কাজের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে সহায়তা করবেন।
এছাড়া রয়েছে শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ চত্বর (প্রত্যয় ৭১), বুদ্ধিজীবী চত্বর, মুক্ত মঞ্চ, বিজয় অঙ্গন ইত্যাদি। এসব ঐতিহ্যগত স্থাপনা বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালির সংগ্রামী চরিত্রের অনন্য প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন জাতীয় উৎসব এবং গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা এ স্মারকগুলোকে সামনে রেখে আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটায়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশ যে কোন নতুন শিক্ষার্থীর মন ও মেধায় বিশেষ বার্তা সংযোজন করবে। হাতির কবর, পীর শাহজামান দীঘি, পুরাতন জমিদার বাড়ি ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম।
৪.
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সামষ্টিক জ্ঞানের সমাহার। এখানে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়। একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি বিভ্ন্নি রকমের কো-কারিকুলার কার্যক্রমের সাথে সংযুক্ত থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধা ও মননকে বিভিন্নভাবে শাণিত করার সুযোগ পায়। ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা মননের বিকাশ ও নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ পায়। বিশেষ করে সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে নাটক একটি অনন্য মাধ্যম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ড্র্রামাটিক ক্লাব সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি ডিবেটিং সোসাইটি, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, ধ্রুবতারা; সংগঠনগুলো ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিকাশের চর্চা ও নেতৃত্ব বিকাশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও সামাজিক সংগঠন হিসেবে রোটার্যক্ট ক্লাব, সিআরসি ইত্যাদি সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং বিশেষ বিশেষ দিনে তারা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বিষয়গুলো অত্যন্ত ইতিবাচক এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, এই বছরে বেশ কিছু সংগীতের দলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাভাবিপ্রবিতে।
৫.
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিদেশে শিক্ষা বৃত্তি নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই অধ্যয়নরত রয়েছে আবার অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশে ফেরত এসে দেশ সেবায় নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশেষ করে বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সরকারের পলিসি প্রণয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করার সক্ষমতা দেখিয়েছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি এবং এ সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সমন্বয়েই সামগ্রিকভাবে অর্জিত হবে বলেই বিশ্বাস করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।
লেখক: প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।