চৌদ্দ বছরের এক কিশোরকে তার জীবনের সবচেয়ে নির্মম আর কষ্টের খবর দিয়ে চিকিৎসক বললেন, ‘১০ বছর পর চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে তুমি।’
অন্য কেউ হলে, হয়তো এমন খবরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তো। এক রাশ হতাশায় একটু একটু করে অন্ধকার গ্রাস করতো সোনালী জীবনকে। কিন্তু সেই কিশোরটি জীবনের ইতিহাসে লিখেছেন বেঁচে থাকার রূপকথা। তীব্র সাহস আর মনোবল দিয়ে চিকিৎসকের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে সেই রূপকথার নায়ক শাহীন রেজা রাসেল।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একের পর এক অাত্মহত্যার ঘটনা নাড়া দিয়েছে সবাইকে। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই গণমাধ্যমে এমন সংবাদে উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ, চিন্তিত অনেকের পরিবার।
এমন হতাশা অার উদ্বেগের মধ্যে যেন জীবনের নতুন অর্থ জানালেন রাসেল। তার কাছে জীবনের অর্থ মরে যাওয়া নয়, বরং সেই মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করাই জীবন।
এই তো কয়েকদিন আগেও চিকিৎসকরা শাহীন রেজা রাসেলকে জানিয়েছেন, তার হাতে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়। তারপর মৃত্যু অবধারিত। কারণ তার শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ফুসফুস এবং হার্টের পেশীও আস্তে আস্তে দুর্বল হওয়ার পথে।
কিন্তু এই অবস্থাতেও থেমে থাকেননি তিনি, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মানুষকে নতুন করে বাঁচার। চ্যানেল আই অনলাইনকে তার বেঁচে থাকা এবং লড়াইয়ের গল্প শুনিয়েছেন। সবাইকে অনুরোধ করেছেন, মৃত্যুর কাছে হেরে না গিয়ে জীবনকে নিয়ে ভাবতে।
রাসেল দীর্ঘদিন ধরে মরণব্যাধী ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রফিতে ভুগছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর কোথাও এই রোগের কোনো চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। হুইলচেয়ারে বন্দী জীবন-যাপন করেছেন তিনি।
হুইলচেয়ারে করেই ইতোমধ্যেই ঘুরে বেড়িয়েছেন সারাদেশ। জীবিকা নির্বাহ করছেন চাকরি করে। জড়িত রয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। রাসেল যে রোগে আক্রান্ত সেই রোগীরা মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন আইসিইউতে ভুগে মৃত্যুবরণ করে। আর সেজন্য একটি একটি করে টাকা জমাচ্ছেন তিনি।
এখন চিকিৎসক বলছেন, রাসেল আর বড়জোর সাড়ে তিন বছর বাঁচবেন। কিন্তু চিকিৎসকের এই কথাতেও সায় নেই রাসেলের। কৈশরের সেই দৃঢ়তা বিশ্বাস মনের জোরেই তিনি ওই সময়ের চেয়ে আরাে কয়েক বছর বেশি বাঁচবেন।
জীবনের সাথে প্রতিনিয়তই লড়াই করে চলেছেন রাসেল। পরিবার, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত সব জায়গাতেই যুদ্ধ করতে হয় প্রতিনিয়ত।
পরিবারের অমতেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এক সহপাঠীর সাথে। বিয়ের পর বেকার থেকেছেন প্রায় দু’বছর। সেসময় কিছুদিন নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটে দোকান নিয়ে বসেছেন। চেষ্টা করেছেন প্রেসের ব্যবসা করার। কিন্তু কোনোদিন ভেঙে পড়েননি। জীবনের প্রতিটি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ভীষণ মূল্যবান রাসেলের জীবনে।
হতাশ হয়ে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চান তাদের উদ্দেশ্যে রাসেল বলেন, জীবন খুবই মূল্যবান। মানুষ কখনো হেরে যায় না। মানুষ শুধু সংগ্রাম করতে ভয় পায়। জীবনকে দেখতে হবে। জীবনের মূল্যটা বুঝতে হবে। আমার মনে হয় যারা আত্মহত্যা করে তারা জীবনকে খুব কম দেখে।
জীবন যদি একবার চলে যায়, সে জীবনকে অার ফিরিয়ে আনার কেনো উপায় নেই উল্লেখ করে রাসেল বলেন: আমার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় আছে মানুষ সেটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। সামান্য প্রতিকূলতা দেখা দিলেই আমরা তার সাথে লড়াই না করে আত্মহত্যা করছি।
‘‘প্রেম, দারিদ্রতা, চাকুরি এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে আমরা আত্মহত্যা করছি। কিন্তু আজ যে ছেলেটা চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করছে ১০ বছর পর সে বেঁচে থাকলে একজন সফল মানুষ হতে পারত।’’
রাসেল পরামর্শ দিয়েছেন আশপাশের দু’এজনকে দেখে বিচলিত না হয়ে অনেক মানুষকে দেখে তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের জীবনকে বুঝতে।