প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারিরা জনগণের টাকায় পরিচালিত হয়; প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারিরা জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কর্মযজ্ঞ মাথায় নিয়েই চাকরিতে যোগদান করার পরপরই দায়িত্বজ্ঞানকে ভুলে প্রচলিত ধারায় সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ ও ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজেই সরকারি চাকুরিতে যোগদানের পূর্বে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতার প্রশিক্ষণ জরুরী বলে মনে করছি যার প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের নিকট প্রদেয় সেবার মান বর্তমানের ন্যায় বৃদ্ধি ও উন্নত হবে।
বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবার মান কেমন, সেবা প্রার্থীদের কী ধরনের ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়, সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে কী কী বাধা কাজ করে, দায়িত্বশীলদের ভূমিকা কেমন, সমস্যা উত্তরণে গ্রহণীয় কর্তব্য কী হতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কেননা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল দশা ও সেবা দাতা এবং গ্রহিতাদের অপর্যাপ্ততা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক হালহকিকতকে ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
করোনাকাল আমাদেরকে সততা, সাধুতা, ন্যায়নীতি পরায়ন, কর্তব্যনিষ্ঠ, পরোপকারী ইত্যাদি বিশেষণগুলোকে আত্নস্থ করতে সহায়তা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়, করোনাকাল এক শ্রেণির অসাধু মানুষের নিকট আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ওই শ্রেণিটি সাধারণ মানুষদের সামনে নানাভাবে প্রতারণা, প্রলোভন, প্রবঞ্চনা ও ধৃষ্টতার নমুনা রেখেছে। করোনাকালে হাসপাতালের অবস্থা আরো ভয়ানক, করোনার উপসর্গ না থাকা স্বত্ত্বেও রোগীদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে অপারগতার চিত্র পত্রিকার পাতায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও রোগীকে ভর্তি করতে না পেরে পথেই রোগীর অমানবিক মৃত্যুর চিত্রও আমরা পত্রিকার পাতায় দেখেছি। অসাধু শ্রেণি করোনাকে হাতিয়ে রোগীর স্বজনের নিকট হতে অতিরিক্ত হারে ঘুষ আদায়ে হীন চেষ্টায় মেতে উঠেছে; হাসপাতালে এমনিতেই ঘুষের প্রচলন রয়েছে তন্মধ্যে করোনাকালে সেটির মাত্রা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাধারণ মানুষের নিকট এখনো সরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণ মানুষ বলতে তাদেরকে বোঝানো হয় যারা ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সুযোগ না পায়। মূলত তারাই এখনো সরকারি হাসপাতালে সেবাগ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, এ শ্রেণির মানুষের সংখ্যা এখনো বেশি এবং তাদের অধিকাংশই এখনো গ্রামেগঞ্জে বসবাস করেন। কাগজ কলমে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যতই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও রিজার্ভের কথা উল্লেখ করি না কেন রাষ্ট্রের অধিকাংশই মানুষই চিকিৎসা সেবা গ্রহণে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা সঠিকভাবে পায় না। সরকারি হাসপাতালে রোগী নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রলিতে উঠানোর সাথে সাথে এক শ্রেণির দালাল চলে আসে সামনে এবং তাদেরকে উপেক্ষা করে রোগী ভর্তি ও সেবা নেওয়া অনেকাংশে কষ্টকঠিন হয়ে পড়ে। অবাক করার মতো বিষয় হলো ঐ শ্রেণির দালালদের সঙ্গে দায়িত্বরত নার্স এবং ডাক্তারদের যোগসূত্র দেখা যায়।
ঐ দালালের কাজ হলো প্রাথমিকভাবে রোগীকে দায়িত্বরত ডাক্তারের মাধ্যমে দেখিয়ে সুনির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পৌঁছিয়ে দেয়া, বিনিময়ে তাকে খুশি করার স্বার্থে ভাল অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হয়। শুরুতেই বলেছি, হাসপাতালে রোগী এবং তাঁর স্বজনরা অত্যন্ত অসহায় এবং রোগীর স্বার্থেই তড়িগড়ি করে দালালদের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্বজনরা থাকে বদ্ধপরিকর। কেননা, স্বাভাবিক উপায়ে রোগীকে নিয়ে গেলে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় বিধায় স্বজনরা টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করে না।
পরবর্তীতে বাকি রইলো ডাক্তার এবং নার্স; সরকারি হাসপাতালগুলোতে হলফ করে বলা যায়, নার্স থেকে শুরু করে ডাক্তার পর্যন্ত প্রত্যেকের মাঝে উদাসিনতা দেখা যায়। এমনও দেখা যায়, একটি ওয়ার্ডে ৬-৭ জন নার্স ও ওয়ার্ডবয় দায়িত্বরত অবস্থায় থাকে কিন্তু প্রকৃতঅর্থে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ২-১ জনকে। জুনিয়র ও কম অভিজ্ঞ নার্সদের রোগীর কাছে পাঠিয়ে গাল-গল্প করতে দেখা যায় অধিকাংশ নার্সদের। রোগীর প্রয়োজনে নার্সদের শরণাপন্ন হলে অনেক সময়ই নার্সরা আসতে অপারগতা প্রকাশ করে। ৮ ঘণ্টা ডিউটি তো সঠিকভাবে পালন করে না সহসাই, আবার সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ার কত পূর্বে হাসপাতাল থেকে বের হওয়া যায় সে প্রতিযোগিতায় অনেককে করতে দেখা যায়।
সবশেষে দেখা যায়, সম্মানিত ডাক্তার সাহেবদের দায়িত্বপালন; দ্রুত সময়ের মধ্যে রোগীর সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করার চেষ্টা দেখা যায় ডাক্তারদের। যার ফলে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের ডাক্তারদের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি দেখা যায়, ওয়ার্ডবয় এবং নার্সরা বিভিন্ন রোগাক্রান্ত রোগীকে ভাল পরিবেশ এবং চিকিৎসার দোহাই দিয়ে দায়িত্বরত ডাক্তারদের অধীনে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হবার পরামর্শ দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, পরামর্শদাতার সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান হতে বিভিন্ন হারে কমিশন পেয়ে থাকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)