কলম্বো, শ্রীলংকা থেকে: দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকার শৌর্য-বীর্যের প্রতীক সিংহ। জাতীয় পতাকা থেকে ক্রিকেট দল, সবকিছুতেই ‘সিংহ-রাজের’ জয়জয়কার। লংকা-জয়ে রামভক্ত হনুমানের প্রশস্তিগাঁথা বহুল প্রচারিত। তবে শান্ত প্রাণী হাতির প্রতি শান্তিপ্রিয় শ্রীলংকাবাসীর ভালোবাসা ও যত্ন আত্তির কমতি নেই। জঙ্গলে অনাদরে বেড়ে ওঠা দলচ্যুত হাতি শাবকের লালন-পালন ও প্রজননের জন্য শ্রীলংকার সাবারাগামুয়া প্রদেশের পিনাওয়ালা জঙ্গলে গড়ে ওঠা ‘এলিফ্যান্ট অরফানেজ’র খ্যাতি সারা দুনিয়াজুড়ে।
কলম্বো থেকে ক্যান্ডিগামী মহাসড়কের একটি পাহাড়ি অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে গড়া হয়েছে হাতির এই অভয়ারণ্য। শ্রীলংকার পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পিনাওয়ালায় এই হাতির খামার, লালন-পালন ও প্রজননকেন্দ্র। ১৯৭৫ সালে পাঁচটি শাবক নিয়ে যাত্রা শুরু এলিফ্যান্ট অরফানেজের। ১৯৭৮ সালে শ্রীলংকার ডিপার্টমেন্ট অফ ন্যাশনাল জুওলজি দায়িত্ব নেয় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার। জঙ্গলে দলচ্যুত হাতি এবং হাতি শাবক ছাড়াও শ্রীলংকার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে আহত হাতিদের আশ্রয় ও পরিচর্যা কেন্দ্রে পরিণত হয় পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ।
জঙ্গল ও পাহাড়ঘেরা ২৫ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই অভয়ারণ্য। মহাসড়ক পেরিয়ে হাতির দঙ্গলকে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলের পশ্চিম পাশে মাহাওয়া নদীর তীরে। সেখানে নদীতে হাতির দল মহাআয়োজনে সারে স্নান পর্ব। অরফানেজে হাতির পাল’কে দুই ভাগে ভাগ করিয়ে গোসলের জন্য নদীতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে মহাসড়কের রাস্তা পার হয়ে হাতির দল যায় জলকেলিতে। তাদের যাত্রা নিরাপদ করতে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। জুওলজি ডিপার্টমেন্টের কর্মী ছাড়াও ৪৮জন মাহুত অরফানেজে ঠাঁই পাওয়া ৯৪টি হাতির নিয়মিত দেখাশুনা করে।
অরফানেজকে কেন্দ্র করে পিনাওয়ালা অঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট, সুভ্যেনির শপসহ অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র। ইউরোপ, আমেরিকানদের জন্য আড়াই হাজার হলেও সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকরা সাতশো রুপী প্রবেশ’ফি দিয়ে অরফানেজ পরিদর্শন করতে পারেন। পর্যটকদের কাছ থেকে অর্জিত আয় দিয়েই চলে এলিফ্যান্ট অরফানেজ।
খাওয়া, চিকিৎসা, নিরাপদ জীবনসহ হাতি পোষার এই বিশাল খরচ উঠে আসে পর্যটকদের কাছ থেকে পাওয়া আয় থেকে। হাতিদের ঘাস, কলাগাছ, কাঁঠাল, নারিকেল, তরমুজসহ অন্যান্য ফল ছাড়াও দুধ পান করানো হয়। প্রতিদিন সকাল সোয়া নয়টা, দুপুর সোয়া একটা এবং বিকাল পাঁচটায় হাতিদের তিনবার খাওয়ানো হয়। পর্যটকরা চাইলে মাহুতের মাধ্যমে হাতির পাল’কে খাওয়াতে পারেন। এজন্য অরফানেজের সরবরাহ করা খাবার কিনে মাহুতের তত্ত্বাবধানে হাতিকে খাওয়াতে হয়।
অবশ্য যেকোন দুর্ঘটনা রোধ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে ট্র্যাংকুলাইজার বন্দুক নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন রক্ষীরা। অরফানেজ কর্তৃপক্ষ হাতি প্রজনন ও হাতির শাবকের পরিচর্যার কাজটিও গুরুত্ব দিয়ে করেন। দিনের শেষে রাতে হস্তিনিদের পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হয় চার দেয়ালের শেডে। সক্ষম পুরুষ হাতিদের দিয়ে ভারি পণ্য বহনের কাজও করানো হয়। সুস্থ নীরোগ হাতির পাল’কে কর্তৃপক্ষ নিরাপদ জঙ্গল বা সাফারি পার্কে ছেড়ে দেন বিলুপ্তির শঙ্কায় থাকা প্রাণীটির সংখ্যা বাড়ানো ও নিরুপদ্রব জীবনযাপন নিশ্চিত করতে।