Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

সৎ অসৎয়ের অসম জীবনবোধ ও আগামী প্রজন্ম

“কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।” – ছোট বেলার এ কবিতাটি যে কতটা বাস্তব সংগত তা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে নতুন করে উপলব্ধি যায়। প্রকৃত পক্ষে পার্থিব সম্পদের মাঝে ভোগবাদী স্বর্গ রচনা করতে গিয়ে সমাজে এক বৈষম্যতার দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। আর সে দেয়াল ভাঙ্গার লড়াইয়ে এসেছে বেশ কিছু প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে এখন মানুষে মানুষে বৈষম্যতার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে দুর্নীতি। আর এ দুর্নীতির অক্টোপাসে জড়িয়ে স্বর্গসুখে বিভোর ব্যক্তিরা সৎ অসৎ’য়ের সংজ্ঞাটা ভুলে গেছে। অসততার পথে চাহিদার শেষ নেই বলে কোটি কোটি টাকার অন্তরালে তাদের লোলুপ চাহনি ফুটে উঠে কেবল। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছে কিছু মানুষ ৷ কারণ সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা আছে বলে তারা মনে করে না।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছে তার শিকড় উপড়ে ফেলা কি এত সহজ হবে? সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এর উত্তর, না।

কারণ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আজকের মতই দুর্নীতিগ্রস্থ দেশকে দেখেছিলেন বলে কঠোর হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে তারই কাছের মানুষরা বিরাগভাজন হয়েছে। আর ইতিহাস দেখলে বুঝা যায় রাজনৈতিক প্রশানিকভাবে দুর্নীতিবাজদের কোন কমিটমেন্ট থাকে না। এরা সময়ের সাথে সাথে কেবল সাপের মত খোলস পাল্টায়। ‘

‘ রাজা আসে, রাজা যায়’ – কিন্তু অসৎ দুর্নীতিবাজ ঘুষখোররা বহাল তবিয়তে থাকে। কারণ তারা মুষ্টিমেয় হলেও তাদের কাছে জিম্মি সাধারণ মানুষ ও সরকার।  আত্মকেন্দ্রিক ভোগ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত তাদের পরিবার। আর সৎ পথে ফিরে আসা তাদের জন্য সম্ভব হয়ে উঠে না অন্তহীন চাহিদার জন্য। তাই সরকারি চাকুরীজীবীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করার পরেও ঘুষ ছাড়া টেবিল থেকে ফাইল নড়ে না। ব্যবসায়ীরা জনগণকে জিম্মি করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে নানা ছল চাতুরীতে।

দুর্নীতি এখন একটা চেইনের মত কাজ করে বলে এর প্রভাব পড়ছে পরিবারের সন্তানদের উপর। কারণ ভালো থাকার সংজ্ঞাটা করা হয় টাকার পরিমাণ দিয়ে। আর তাই সৎ অসৎয়ের যাপিত জীবন বোধের বৈষম্যতা আগামী প্রজন্মকে কেবল অন্ধকারেই নিমজ্জিত করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

একটি দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে হলে আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করতে হবে। তাদেরকে সুস্থ জীবনের সাথে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য।

বৈষম্যতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা সন্তান থেকে ভালো কিছু পাবার প্রত্যাশা কমে যায়। যখন একটি সন্তান বড় হয় তার বাবা মা পরিবার আর চারপাশের সমাজকে দেখে। সেখানে দেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাতে তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতার কারণে সততার বোধটা হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যা দেশের প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। তিনি আগামী প্রজন্মের চিন্তাতে শঙ্কিত হয়ে বলেন – “যারা সৎভাবে জীবন যাপন করতে চায়, তাদের জন্য বা তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য সৎভাবে জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে যায়, যখন অসৎ উপায়ে উপার্জিত পয়সা সমাজকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। কারণ একজনকে সৎভাবে চলতে গেলে তাকে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলতে হয়। আর অসৎ উপায়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এই ব্র্যান্ড, ওই ব্র্যান্ড, এটা সেটা হৈ চৈ,… খুব দেখাতে পারে। ফলাফলটা এই দাঁড়ায়, একজন অসৎ মানুষের দৌরাত্ম্য যারা সৎভাবে জীবন যাপন করতে চায় তাদের জীবনযাত্রাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ছেলেমেয়েরা ছোট শিশু, তারাতো আর এতটা বোঝে না। ভাবে যে ওরা এইভাবে পারে তো আমাদের নাই কেন।

এটা স্বাভাবিক, তাদের মনে এই প্রশ্নটা জাগবে। ওত ছোট ছোট বাচ্চারা, তারা সৎ-অসতের কী বুঝবে। তারা ভাবে আমার বন্ধুদের এত আছে, আমাদের নাই কেন? যা স্বাভাবিকভাবে মানুষকে অসৎ উপায়ের পথে ঠেলে দেবে।”

অসম এ প্রতিযোগিতার রোগের চিকিৎসা করতে হলে, আগামী প্রজন্মকে সততা অসততার নৈতিক শিক্ষাটা দিতে হবে। তা না হলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না ।

জননেত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের নীরব সর্মথন শতভাগ আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, যে যার অবস্থান থেকে উচ্চকিত কণ্ঠে প্রতিবাদ করার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছে বাস্তবতার নিরিখে। কেননা ঘুষ না দিলে কাজ হয় না,চাঁদা না দিলে জীবন বিপন্ন, কিংবা চাকরির বদলি হবে না নির্ধারিত টাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা না পেলে এরকম হাজারো কারণে মানুষ মনে করে প্রতিবাদ করে কি হবে। বরং নিজেই বিপদে পড়ব। এক কথায় একে বলা যায়, ‘ নৈতিকতার অবক্ষয়। ‘

প্রধানমন্ত্রী যখন নিজের ব্যক্তিদের ছাড়া দিতে নারাজ সেখানে দেশের জনগণের নীরব সমর্থনের চেয়ে সরব প্রতিবাদ করার এখনই সময়। কোন কিছুকে সাময়িক ঘটনা হিসাবে না নিয়ে নিজের বিবেককে জাগ্রত করাটা খুব জরুরী এ মুহূর্তে । প্রতিটি সরকার আমলে দুর্নীতি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং এর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সর্বাত্মক ভাবে করা দরকার।

ক্যাসিনো-গডফাদারসমগ্র সরকার ব্যবস্থাতে প্রতিটি পদক্ষেপ একটা আইনি প্রক্রিয়া দিয়ে পরিচালিত হয়। আর তাই দুর্নীতি, অবৈধ কার্যকলাপের শেকড় উপড়ে ফেলতে হলে নিজেদের মাঝে ‘ প্রতিবাদ করে কি হবে’ – এ ধারণাটা ভুলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে কু রিপুর অবদমন করতে না পারলে আগামী প্রজন্মকে সত্যিকারের সোনার বাংলা দেয়া সম্ভব হবে না। তাই অসৎ জীবন থেকে সরে সৎ পথের পথিক হতে আর একবার কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি –

“রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,

আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।

প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে। ”

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

Exit mobile version