যাঁর সাথে কথা বলে, আড্ডা দিয়ে, কবিতা পড়ে মুগ্ধ হতাম আজ তাঁকে নিয়েই লিখতে হচ্ছে। হতাশার কথা বলতে গিয়ে যাঁর প্রেরণায় নতুন স্বপ্নে বিভোর হতাম আজ তাঁকে নিয়েই লিখতে হচ্ছে। হ্যাঁ আমি আমার প্রিয় শাকিল ভাইয়ের কথাই বলছি।
প্রয়াত কবি রফিক আজাদের আড্ডায় পরিচয়, তারপর ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হওয়া এইতো সেদিনের ঘটনা। এতো বড় মাপের মানুষ হয়েও সবাইকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা সত্যি স্বপ্নের মতো। খুব দীর্ঘ সময় শাকিল ভাইকে কাছে পাইনি। কিন্তু এই অল্প সময়ে কত আড্ডা, কত গল্প, কত স্বপ্ন। যে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে সে স্বপ্ন দেখাতেও পারে। অস্বীকার করার উপায় নাই তার দেখানো স্বপ্নের কারণেই নিজেকে বড় ভাবতে পারতাম, নিজেকে এগিয়ে নেয়ার প্রেরণা পেতাম।
ফেসবুকের ডিজিটাল পাতায় কবিতা লিখে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রকাশক হিসেবে কবিতার বই প্রকাশে আগ্রহ দেখালে প্রথমে প্রত্যাখ্যান, অবশেষে নানা অনুনয় বিনয়ের পর সম্মতি প্রদান। যার ফলে ২০১৫ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ প্রকাশ। অমর ২১শে গ্রন্থমেলায় অন্বেষা প্রকাশন এর স্টলের সম্মুখে ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন। কত প্রিয় মানুষের পদচারণা- কবি, লেখক, রাজনীতিক, সাংবাদিক, গুণগ্রাহী পাঠকসহ আরো কতো প্রিয় মানুষের উপস্থিতি।
প্রতিদিনের পদচারণায় অন্বেষার স্টলটি হয়ে উঠতো আনন্দমুখর। বই প্রকাশের পূর্বে শাকিল ভাই বলেছিলেন ২/১ দিনের বেশি বইমেলায় সময় দিতে পারবেন না, অথচ বই প্রকাশের পরে ২/১ দিন বাদে বাকী সময়গুলো স্টলেই ব্যয় করতেন। অনেক সময় জরুরি রাষ্ট্রীয় কাজের কারণে সারা বিকেল বইমেলায় আসতে না পারলেও সন্ধ্যার পরে চলে আসতেন। মেলায় শুধু নিজের বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়েই ক্ষ্যান্ত থাকতেন না। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন স্টলে খুঁজে খুঁজে প্রিয় বইগুলো কিনতেন। পুরো মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে ঘুরে দেখতেন। সকলের সাথে কুশল বিনিময়, খোঁজ-খবর নেয়া সেই সাথে আড্ডাতো আছেই।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তার মধ্যে কবি হয়ে উঠার প্রবণতা লক্ষ্য করার মতো। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকার পরেও তিনি চেয়েছেন তাঁর পরিচয় হোক কবি মাহবুবুল হক শাকিল নামে। কবিতাই ছিলো তাঁর অন্তপ্রাণ। প্রতিনিয়ত কবিতা লিখতেন, আবার ভালো না লাগলে অনেক কবিতাই ফেসবুক থেকে মুছে ফেলতেন এবং আবার লিখতেন। সমসাময়িক কোনো কবি এতো অল্প সময়ে তাঁর মতো এতো কবিতা লিখেছেন কিনা আমার জানা নেই। অনেক কবিতা লিখা হলেও ২০১৬ সালে সেখান থেকে বাছাই করে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মন খারাপের গাড়ি’ প্রকাশিত হলো।
আবারও সেই ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে তাঁর প্রিয়জনেরা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন। এই কাব্যগ্রন্থটি বইমেলায় রেকর্ড পরিমাণ পাঠক প্রিয়তা পেলো। কবির উচ্ছ্বাস আর আমার আনন্দ মিলেমিশে একাকার। কবি এবার ঘোষণা করলেন কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস লিখবেন। কিন্তু শুরু করলেন গল্প লেখা, কারণ জানার আগ্রহ দেখালে বললেন, আরো পরে সময় নিয়ে উপন্যাস লিখবেন। কবিতার পাশাপাশি গল্প, গান লিখলেও কবিতা লেখা তাঁর চলতেই থাকলো।
বিভিন্ন পত্রিকায় শাকিল ভাইয়ের কবিতা, গল্প ছাপা হতে লাগলো। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ৩য় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের। কাব্যগ্রন্থের নাম, কবিতা বাছাই অনেক দূর এগিয়েছে। এরই মধ্যে ৬ ডিসেম্বর ২০১৬ বাংলাবাজার বসে আছি, আড্ডা দিচ্ছি হঠাৎ কাছের এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে খবরটি জানালো। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলাম না, ছুটে গেলাম। যাঁর অনুপ্রেরণায় নিজেকে বড় ভাবতে শিখেছি, নিজেকে সাহসী ভাবতে শিখেছি সেই প্রিয় কবি মাহবুবুল হক শাকিল ভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
সাহিত্য জগতে এসে তিনি কি শুধু একজন কবি হয়েছেন, তিনি সকল কবি লেখকের দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে অনেকের চিকিৎসা করিয়েছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
শুধুমাত্র কবি লেখকের জন্য নয়, প্রকাশকদের মানোন্নয়নেও তিনি এগিয়ে এসেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আইপিএ সদস্য লাভে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, শুধু তাই নয় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ‘বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি’র নামে স্টল বরাদ্দ পাওয়া, কলকাতা বইমেলায় তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রকাশকদের জন্য ঢাকায় ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাবার উদ্যোগ তিনিই গ্রহণ করেছিলেন।
পরোপকারী, নিরহংকার এ মানুষটি এতো তাড়াতাড়ি না ফেরার দেশে চলে যাবেন ভাবতেই পারিনি। তাঁর এ অকাল প্রয়াণেই উপলব্ধি করেছি কতো গুণগ্রাহী, কতো তারুণ্যের মন জয় করেছিলেন তিনি। পরিবারের সদস্যরা তাঁদের পরিবারের প্রিয় মানুষটিকে হারিয়েছেন। আর আমি হারিয়েছি আমার স্বপ্ন, আমার সামনে চলার প্রেরণা আমার প্রিয় শাকিল ভাইকে। প্রিয় শাকিল ভাই, না ফেরার দেশে আপনি ভালো থাকুন।