Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

টু-ইন-ওয়ান আর ‘জাকনদানি’ ক্যাসেট

সন্ধ্যায় আব্বা যখন বাড়ি ফিরে আসতো, তখন তার হাতে অবধারিতভাবে কিছু না কিছু, বিশেষ করে খাবার দাবার থাকতোই । আর তাই আমরা বেশ বড় হওয়ার পরেও বাচ্চাদের মত অপেক্ষায় থাকতাম যে আব্বা কখন ফিরবে ? পুরি, সিঙ্গারা, কাটলেট, চকলেট, কেক, চানাচুর, বিস্কুট, মিষ্টি, শন পাপড়ি থেকে শুরু করে ফলমূল, মাছ, মুরগী সবই থাকতো । আমি যেসময়ের গল্প বলছি, সেসময় সাধারণত বাবারাই চাকরি করতো । বাবারাই অফিস থেকে ফিরতো, বাবারাই প্রতিদিন বাজারে যেত। সময়টা ছিল ৭০/৮০ এর দশক।

তবে বিপদজনক ব্যাপার ছিল এভাবে বাড়ি ফেরার পথে এটা সেটা কিনতে গিয়ে আব্বা প্রায়ই  ‘ধরা খেতো’  বা ক্ষতির মুখে পড়তো। যেমন আকছার তাকে ‘নানা’ ‘নানা’ ডেকে মাছওয়ালারা পচা মাছ গছিয়ে দিতো । ৮টি মুরগি কিনলে ভেতরে ২টি মরা মুরগি থাকতো, ৫ কেজি টমেটো আনলে ২ কেজি চোখ বন্ধ করে ফেলে দেয়া যেতো । দেখতাম মোটামুটিভাবে এভাবেই ‘ফালতু’ জিনিস কিনে এনে বাসায় আম্মার হাতে আব্বাকে হেনস্তা হতে। মাঝারি আয়ের সংসারে এইভাবে টাকা নষ্ট আম্মা একদমই মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এই বকাবাদ্য, তার ছিলনা কোন বিকার ।

এরকমই এক সন্ধ্যায় আব্বা বাড়ি ফিরলো কোন খাওয়া দাওয়া নিয়ে নয়, একেবারে আস্ত একটা টু-ইন-ওয়ান হাতে নিয়ে। সময়টা সম্ভবত তখন ৮৪/৮৫ সাল। আমরা বেজায় খুশি। দারুণ উত্তেজনা। ইশ! কী আনন্দ, সারাদিন পছন্দমত গান শোনা যাবে । রেডিওতে গান শোনার জন্য আর বসে থাকতে হবেনা। তবে আমরা সবাই একটু অবাক ও হতাশ হলাম টু-ইন-ওয়ানটির ব্র্যান্ডের নাম দেখে, নাইট (শহরময়) কোম্পানির তৈরি এটি। এটা আবার কোন ব্র্যান্ড, কখনতো আমরা এই নাম শুনিনি। সনি, হিটাচি, ফিলিপস থাকতে এটা আবার কী কোম্পানি ?

জানতে চাইলাম আব্বা কোথা থেকে কিনেছো এটা ? বললো, স্টেডিয়াম থেকে। বললাম,  ‘কেন এরকম একটা আজব কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান কিনলা ?’ আব্বার উত্তর শুনেতো আরো অবাক। বলল,  ‘আমিতো কিনি নাই । রিকশায় বসেছিলাম, নাজমুলকে (আব্বার নিয়মিত সাগরেদদের মধ্যে একজন ) টাকা দিলাম, ও দোকান থেকে কিনে আনলো । কেন কী সমস্যা হইলো তোদের এই কোম্পানির নাম নিয়ে ? চেহারাতো বেশ ভাল, সাইজও বড়, গানও বাজতেছে । তাহলে তোদের আপত্তিটা কোথায় ?

‘এত শখের একটা দামি জিনিস কেউ কি রিকশায় বসে কিনতে পারে ? কোন ব্র্যান্ড বিচার বিবেচনায় না এনে নাইট কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান ? উহ, এ কেবল আব্বার পক্ষেই সম্ভব । এইভাবে যে কোন মানুষ একটা শখের ইন্সট্রুমেন্ট কিনতে পারে, আজ আমরা কল্পনাও করতে পারিনা।

আর সেসময়তো পারতামই না । কারণ টাকা পয়সার যোগান এতটাই সীমাবদ্ধ ছিল যে শখ নামক বস্তুটিই ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে । সেইসময় একটি টু-ইন-ওয়ান কেনা আজকালকার দিনে একটি নতুন গাড়ি কেনার সমান। আজকের দিনে অনেকে হয়তো বুঝতেই পারবেনা টু-ইন-ওয়ান কি এবং একটি নতুন টু-ইন-ওয়ান কেনার মাজেজা। এখন এই জিনিস আর পাওয়াই যায়না ।

তবে  ‘বাজে ব্র্যান্ড’ নিয়ে আব্বার তেমন কোন মাথাব্যথা না থাকলেও এই খবরটা যেন আম্মার কানে না যায়, আব্বা বেশ রাগত্ব স্বরে সেকথা আমাদের জানিয়ে দিলো। আর এরপর ১০/১৫ দিন বাসায় কোন অতিথি এলে আব্বা তাকে প্রায় জোর করে নাইট কোম্পানির টু-ইন-ওয়ান থেকে গান শোনাতো আর এটাতে যে বেশ ভাল গান শোনা যাচ্ছে, সেকথা আদায় করে নিতো । শুধু কি তাই, একফাঁকে তাকে আম্মার কাছেও গিয়ে বলতে হতো যে, বাসায় খুব ভাল একটি গান শোনার যন্ত্র কেনা হয়েছে । আর ’ নাইট’ একটি ভাল ব্র্যান্ড । কারণ ইতোমধ্যেই আম্মার কানে আমাদের কথোপকথন কিছু কিছু পৌছেঁছে, আর আম্মাও তার স্বভাব অনুযায়ী ‘এই লোকটা’ মানে আব্বা টাকা নষ্ট করে এরকম একটি হদ্দ জিনিস কিনে আনলো, সেকথা বলে আব্বাকে খোঁটা দিচ্ছে ।

এই বড় আকারের গান শোনার যন্ত্রটি , আমাদের সেই আলমারি ফ্রিজটির মত আবার বসার ঘর বা ড্রয়িং রুমে স্থান পেল । কারণ বাসায় আগত অতিথিদের বাধ্যতামূলকভাবে এই টু-ইন-ওয়ানের গান শোনানো হচ্ছে। তবে আমাদের জন্য আরো বড় অসুবিধাটা হয়ে দাঁড়াল যে আব্বা সকালে উঠেই তার খুব প্রিয় এ্কটি কাওয়ালির ক্যাসেট যার নাম ছিল  ‘জাকনদানি’  সেটা চালিয়ে দিতো হাই ভলিউমে। আর আমাদের প্রতিদিন সেটা শুনতে শুনতে ঘুম থেকে উঠতে হতো। শুধু তাই নয়, ঐ অদ্ভুত কাওয়ালি শুনতে শুনতে বাসা থেকে বেরুতেও হতো ।

সময়ের সাথে সাথে আমরা ঐ নাইট টু-ইন-ওয়ানে গান শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। এমনকি আম্মাও এই নাইট টু-ইন-ওয়ানে নিয়মিত মান্নাদে, সতীনাথ আর লতার গান শুনতো এবং সাজগোজ করে এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছে। কয়েক বছর পরে একসময় আম্মা সেই ঐতিহাসিক নাইট টু-ইন-ওয়ানটি মাত্র ২০০ টাকায় কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল বলে শোনা গেছে । সেটা শুনে আব্বার আক্ষেপের কোন অন্ত ছিলনা। প্রায়ই শুনতে হতো – এত ভাল জিনিস কিভাবে তোর মা ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিতে পারলো, তাও আবার ২০০ টাকায়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।

Exit mobile version