দামতুয়া ঝর্ণা থেকে ফিরে: পাহাড়ের গহীনের স্বচ্ছজলের উত্তাল কলতান। সেই স্বচ্ছতায় প্রতিনিয়ত মুখরিত হচ্ছে বান্দরবানের আলীকদমের অপরূপ ‘‘দামতুয়া জলপ্রপাত’’।
পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এ জলপ্রপাতে দিন দিন বাড়ছে ভিড়। ভ্রমণ পিপাসুদের হৃদয়ে স্থান করে নিচ্ছে জলপ্রপাতটি। আলীকদমে অসংখ্য ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের মধ্যে দামতুয়াই সবচেয়ে বড়। শুধু এই উপজেলায় নয়, বাংলাদেশর বড় জলপ্রপাতের মধ্যে এটি অন্যতম। এছাড়াও এখানে রয়েছে ওয়াংপা ঝর্ণা, পোয়ামুহুরী (রূপমুহুরী ঝর্ণা) মেরাংতং ঝর্ণা ও নুনার ঝিরি ঝর্ণা। তবে ভরা বর্ষায় উচ্ছ্বল কলরবে লাফিয়ে চলছে দামতুয়া জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানির ধারা। ইতোমধ্যে দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এই জলপ্রপাতের খবর পৌঁছে গেছে। তাই প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসছেন দামতুয়া ঝর্ণার হিমশীতল জলে সিক্ত হতে।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দুর্গম গহীনে এই জলপ্রপাতের অবস্থান। এর চারদিকের পাহাড় চূড়ায় রয়েছে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী মুরুং (ম্রো) সম্প্রদায়ের বসবাস। ওই (মুরুং) এলাকাবাসীর পথ অনুসরণ করেই পর্যটকদের এই জলপ্রপাতে যেতে হয়। পাহাড় ঝিরি-খাল ডিঙিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয় সেখানে। শুধু জলপ্রপাতটিই নয়, যাওয়ার সময় পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য ভ্রমণপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সম্ভাবনাময় জলপ্রপাত নিয়ে কথা হলে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজিমুল হায়দার বলেন, আমি দেশের অনেক স্থানেই ভ্রমণ করেছি। সর্বশেষ এই ঈদের পর গেলাম আলীকদমের দুর্গমের এই দামতুয়া জলপ্রপাতে। পর্যটকদের ধন্যবাদ দিতে হয়, তারা এত কষ্ট করে পাহাড়-ঝিরি-কাল ডিঙিয়ে পায়ে হেঁটে এই জলপ্রপাত দর্শনে আসেন। স্থানটি অনেক সুন্দর, সু্উচ্চ পাহাড় থেকে উচ্ছ্বল কলরবে লাফিয়ে পড়ছে জলধারা। চারদিকের পরিবেশও অনেক মনোরম। যাতায়ত ব্যবস্থা সহজ করা গেলে এখানে প্রতিদিনই হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসুর ভিড় জমবে, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।
তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে যতটুকু সম্ভব যাতায়াত ব্যবস্থা স্বাভাবিক করে দেয়ার উদ্যোগ নেবো ।একইসঙ্গে এখানে এসে পর্যটকরা যেন বিশ্রাম নিতে পারেন এবং তাদের নিরাপত্তায় কী করা যায় সেটিও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করবো।
ওই জলপ্রপাতে দেখা হয় আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই জলপ্রপাতে প্রায় সময় ছুটে আসি। দেশের অনেক পর্যটনকেন্দ্র ও জলপ্রপাত ভ্রমণ করেছি। তবে এই দামতুয়া জলপ্রপাতের মতো দ্বিমুখী ও সুউচ্চ জলপ্রপাত দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। তাই সময় পেলেই দেখার জন্য চলে আসি। আসতে কষ্ট হয়, তারপরও জলপ্রপাতের আকর্ষণে এখানে বারবার চলে আসি।
প্রকৃতির অপরূপ নিদর্শন এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের উপচেপড়া ঝর্ণা ধারা দেখার মোক্ষম সময় এই বর্ষায়। বর্ষার শুরু থেকেই পাহাড় থেকে সবুজ পাহাড়ের নিস্তব্ধতার মাঝে ঝর্ণা রাণীরা যেন আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতে। তাই সবুজের টানে প্রাণের উচ্ছ্বাসে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত এমন দৃশ্য দেখতে ছুটে আসছেন পর্যটকরা।
দামতুয়া ঝর্ণার দুদিকের খাড়া পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে কলকল, ঝমঝম শব্দে সুরের অনুরণন তুলে উন্মাতাল স্রোত গড়িয়ে পড়ছে নিচের গভীর জলাশয়ে। উঁচু থেকে পড়া পানির কিছু অংশ আবার জলীয়বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে সেখানে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এ যেন পাহাড়ের গভীরে মেঘমালা।
দামতুয়া ঝর্ণায় নামতে হলে খাড়া পাহাড়ের কিছুটা পথ ডিঙিয়ে নীচে নামতে হয়। তবে দামতুয়া জলপ্রপাতে নামার পথ পাথুরে মাটি। সেখানে নামতে তেমন সমস্যা হয়না। ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের নীচে মাঝারি ধরণের জলাশয় রয়েছে। এ জলশয়ে সাঁতার কাটতে ও গোসল করতে বেশ ভালো লাগে।
দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতে পৌঁছানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে দেখা মিলবে ‘‘ওয়াংপা ঝর্ণা’’। মূল ‘‘ওয়াংপা ঝর্ণা’’ দেখতে হলে খাড়া পাহাড় বেয়ে নীচে নামতে হবে। চলাচলের পথের মাঝে অসংখ্য ছোট-বড় পাথরের ভাজে শীতল জল যেন জানান দেয় ওয়াংপা ঝর্ণার স্রোত কেমন হবে। ওপর থেকে ওয়াংপা ঝর্ণার পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আরো মনোহর লাগে।
ধারণা করা হচ্ছে, শতবর্ষ আগে থেকেই প্রবাহিত রয়েছে এসব ঝর্ণা ও জলপ্রপাত।
এতদিন সড়ক যোগাযোগ না থাকা, বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি জনপদ হওয়ায় তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফলে তা অনাবিস্কৃতই থেকে যায়। উদ্যমী তরুণ-যুবকরা পাহাড়ের কন্দরে লুকিয়ে থাকা এসব ঝর্ণা রাণী ও জলপ্রপাতকে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছেন। ফলে পাল্টে যাচ্ছে আলীকদম উপজেলার পর্যটন পরিবেশ। নতুনত্বের ছোঁয়া লাগছে পর্যটনখাতে। সরকারি সহযোগিতা পেলে এসব পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে পর্যটকবান্ধব।
যেভাবে যাবেন দামতুয়া জলপ্রপাতে
বান্দরানের আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার পয়েন্টের আদু মুরুং পাড়া থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের অবস্থান। ১৭ কিলোমিটার পথ জিপ অথবা মোটরবাইকে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হয় পায়ে হেঁটে।