ক’দিন হলো আম্মা ঢাকায় এসেছেন। চায়ের টেবিলে জানালেন, টিএন্ডটি ফোনটা কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে। চোখের সামনে দিয়ে কত কত ছবি (স্মৃতি) স্ন্যাপশট আকারে হুড়মুড় করে ফাস্ট ফরোয়ার্ড মোডে দৌড় দিলো!
ঠিক কতো সালে ফোন লাইনটা বাসায় এসেছিলো মনে নাই। ৯৭ সালে হবে হয়তো। তখন আমরা ছোট দুই ভাই-বোন রাজশাহীর বাইরে থাকতাম। ফাহমিদ (বিপ্লব) ভাইয়া লেখাপড়ার শেষ পর্যায়ে আর আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি।
তো ঢাকায় পড়তে পাঠিয়ে নির্ঘুম রাত কাটতো আম্মা-আব্বার। যোগাযোগের মূল মাধ্যম ছিলো ডাক বিভাগের ২ টাকার খামে ভরা এক-দুই পাতার চিঠি। তাও রোজ লেখা হতো না। সপ্তাহে বড়জোর একটা।
এমন বিচ্ছিন্নিতায় কিছুটা স্বস্তি পেতে ল্যান্ড লাইন বা টিএন্ডটি ফোন আনা হলো বাসায়। খরচ পড়েছিলো ১৮ হাজার বা ২০ হাজার টাকা। কল করার খরচও ছিলো সম্ভবত প্রতি মিনিট ২০-২৫ টাকা। এটা ছিলো আন্ত-জেলা কল রেট। দূরত্ব হিসেব করে এই কল রেট নির্ধারণ করা হতো।
তখন আমার হাত খরচ ছিলো মাসে ১৭শ’ থেকে ২ হাজার টাকা। এই টাকায় ঘন ঘন বাড়িতে ফোন করা অসম্ভব ছিলো। আর আমার কাছে ফোন ছিলো না। থাকলে হয়তো বাড়ি থেকেই ফোন আসতে পারতো। হলে যে ফোন সেট ছিলো সেটা দিয়ে আন্ত জেলা যোগাযোগ সম্ভব ছিলো না। ৫০ পয়সার কয়েন দিয়ে ঢাকার মধ্যেই কথা বলা যেতো। ৫০ পয়সায় সম্ভবত ৩ মিনিট কথা বলা যেতো।
তো, হলে ফোন বুথ আসার আগে আমরা বাড়িতে ফোনে যোগাযোগ করতাম কীভাবে? সেটা একটা উৎসব ছিলো একরকম। দুই ভাইবোন একই বিভাগে পড়েছি। সেই সুবাদে বিভাগের করিডোরে দুই ভাইবোনের দেখা হতো ক্লাসের ফাঁকে।
যেদিন বাড়িতে কথা বলবো সেদিন ভাইয়া করিডোরে দেখা হলে বলে দিতেন, আজ বাড়িতে কথা বলবো। তুই ফ্রি কখন? …টার সময় রেডি থাকিস। ভাইয়া জহুরুল হক হলে থাকতেন, সেখান থেকে আমার হলের সামনে আসতেন। রিক্সায় চেপে দুই ভাই-বোন বিশ্বিবিদ্যালয়ের পাশের এলাকা, নীলক্ষেত যেতাম। সেখানে সারি সারি দোকানে টেলিফোন সেট দৃশ্যমান থাকতো। কোন দোকান কেবলই ফোনে কথা বলার জন্য। আবার কোন দোকান ছিলো মাল্টিপারপাস। অর্থাৎ সেখানে ফটোকপি করা যেতো, লেখার কাগজ, খাম, পেন্সিল, কলম ইত্যাদি পাওয়া যেতো।
এসব ফোনের দোকানে আমরা আধা ঘণ্টা কথা বলতাম ১৫/২০/২৫ টাকায়। হ্যাঁ, আন্তজেলা কলরেট এখানে প্রযোজ্য ছিলো না। লাইনগুলো ছিলো চুরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের টিএন্ডটি কেবল থেকে লাইন চুরি করা থাকতো। পুলিশ এসব জানতো। বেশি কড়াকড়ি হলে এই মার্কেটে রেইড দেয়া হতো। কদিন পর আবার বসতো দোকানগুলো। দুস্থ শিক্ষার্থীদের জন্য এটা ছিলো মুশকিলে আসান!
ভাইয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর হলের রুমমেট বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যেতাম বাড়িতে কথা বলতে। আমাদের বন্ধু রঞ্জুর সঙ্গেও দুয়েকবার গেছি হয়তো। ঠিক মনে নাই আর।
স্ন্যাপ শটের মধ্যে আরো কিছু ছবি ছিলো। বিয়ের আগে প্রেম করেছি ৫ বছর। সেই ৯৯ সাল থেকে। ছুটিতে বাড়ি গেলে যোগাযোগ হতো সেই ফোনেই। ভাইয়া জানতেন এবং সজলকে চিনতেন। দেখা গেছে, দুই ভাইবোন ছুটিতে গেছি, সজল ফোন করেছে, ফোন ধরেছেন ভাইয়া। তিনিই আমাকে ডেকে দিলেন, তোর ফোন এসেছে। বিভাগের বন্ধুরাও ফোন করে খোঁজ নিতো।
এরকম আরো কত কত স্মৃতি! সময়ের ব্যবধানে হারিয়েও গেছে অনেক কিছু। বিয়ের পর আমার শ্বশুর বাড়িতেও ফোন আসতো ওই টেলিফোন থেকে। ক্রস কানেকশনে ভুল কল ঢুকে পড়রার ঘটনাও কম ছিলো না।
এখন যারা দিনের বেশিরভাগ সময় স্মার্ট ফোনে সময় কাটাই তাদের অনেকের পক্ষে এসব অভিজ্ঞতা অলীক মনে হতে পারে। এক সময় যেটা যোগাযোগের ভরসাস্থল ছিলো।
নিজে বাসা নেয়ার পরও একটা টিএন্ডটি ফোন ছিলো। সেটাও বাদ দেয়া হয়েছে ২০১২ সালে। দৈনন্দিন জীবনের অনুষজ্ঞ ছিলো এরকম অনেক কিছু আমরা হারিয়ে বসে আছি। হলুদ খামের সেই দিনগুলো কে না মিস করে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)