ভয়াল মৃত্যু প্রতিদিন তাড়া করছে তাদের। আগুন, গুলি আর মৃত্যুর হানা থেকে প্রাণ বাচাঁতে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে তারা। বাঁচার আকুতি আর মনোবলকে সম্বল করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছেন তারা। হাতের কাছে জমানো টাকা- স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি হাতের কাছে থাকা পোষা প্রাণীগুলোও নিয়ে আসছেন সঙ্গে। তবে সীমান্ত পাড়ি দিলেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ওত পেতে আছে অন্য শত্রু। দৃশ্যমান শত্রুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশে আসা এসব শরণার্থীর অসহায়ত্বের সুযোগে লুট হয়ে যাচ্ছে শেষ সম্বল। কয়েকজনের এসব সিন্ডিকেট অসহায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আনা জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছে সস্তা দামে। নিত্যপণ্য থেকে সর্বক্ষেত্রে চলছে নৈরাজ্যকার পরিস্থিতি। এ যেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে নির্দয় বাণিজ্য। হোয়াইক্যং ও লাম্বার বিল সীমান্ত পার হয়ে রাস্তার পাশে অবস্থান করছিলেন জসিম উদ্দিন। সাথে বউ আর বাচ্চারাও রয়েছে। কথা হলে তিনি বলেন, প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছি। কিন্তু সীমান্তে কিছু লোক আমাদের জিনিসপত্র কিনতে চায়। আমি জিনিস পত্র বিক্রি না করে বিক্রি করলাম টাকা। ১৭ হাজার মিয়ানমারের টাকা তাদের হাতে দিলাম, তারা আমাকে দিয়েছে ১৩শত টাকা। তাদের উগ্র মেজাজে আমি ভয় পেয়ে গেছি। বাংলাদেশের ১ টাকায় মিয়ানমারের ১৬ টাকা হিসেবে প্রতি লাখে ১৬ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু দেওয়া হচ্ছে লাখে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা।
রক্তচোষা দালালচক্রের ভয়ে পানির দরে জিনিসপত্র বিক্রি করে দিত বাধ্য হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। মানবিক এই বিপর্যয়ের সময় সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষ রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ালেও মুনাফালোভীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে হাতিয়ে নিচ্ছে সব। টেকনাফ-উখিয়ার নয়াপাড়া, পালংখালী, বালুখালী, উনচিপ্রাং, হোয়াইক্যং শরানার্থী ক্যাম্পে অবস্থানরত শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র জানতে পারি। টেকনাফের শামলাপুর থেকে শাহপরীরদ্বীপ পর্যন্ত ২০ টি নৌঘাটে ২ হাজারের বেশী ফিশিং বোট রয়েছে। এসব ফিশিং বোট তখন মৎস্য শিকারের পরিবর্তে মিয়ানমার উপকূল থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই করে আনতে ব্যস্ত সময় পার করছে। মাছের পরিবর্তে মানুষ পার করাই এখন তাদের মূল ব্যবসা। প্রতিজন থেকে ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যারা টাকা দিতে পারছে না অথবা টাকার পরিমাণ কম তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয় স্বর্ণালঙ্কার, টাকা, কাপড়-চোপড়সহ যাবতীয় মূল্যবান সামগ্রী। এ অভিযোগে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজনকে সাজাও দিয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর মানুষ তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এসব নিরীহ মানুষগুলো তাদের ভয়ে সব শর্ত মেনে নিচ্ছে। আর এ সুযোগে দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে উঠে এসব সিন্ডিকেট।
পাঁচ পয়েন্টে ছয় সিন্ডিকেট
টেকনাফ উখিয়ার পাচঁটি পয়েন্টে অন্তত ৬টি সিন্টিকেটের অবস্থান করছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি। সন্ধ্যা পার হলেই বের হয় তারা। সাথে থাকে টর্চলাইট। রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জিনিসপত্র সস্তা দামে কেনাই তাদের কাজ। কেউ বিক্রি করতে না চাইলে কেড়ে নেয়ারও অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
মোবাইলের দামে সিম
ওই সিন্ডিকেট সদস্যদের হাত ধরেই রোহিঙ্গাদের হাতে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশি মোবাইল সিম। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রোহিঙ্গারা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগে মোবাইল ব্যবহারের আকুলতার সুযোগে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই এসব সিম বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা করে।
ছাগলের দামে গরু
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে থাকা গরু-ছাগল, মহিষ যেন একেবারে পানির দরে কিনছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। ৬০ হাজার টাকার গরু বিক্রি করতে হয় মাত্র ১৫ হাজার টাকায়। মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী মালেক একটি ষাড় ও একটি গাভি বিক্রি করেছে ৩৫ হাজার টাকায়। ছাগলের দাম আরও কম। ৬০০ টাকা দিয়েও তখন ছাগল বেচা-কেনা হয় সীমান্তে।
রুপার দামে স্বর্ণ
সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসা নারীরা ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ বিক্রি করছে প্রতি ভরি ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকায়। বাধ্য করা হচ্ছে তাদের স্বর্ণ বিক্রি করতে। অন্যথায় ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে ওই সিন্ডিকেট সদস্যরা।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক এ বিষয়ে বলেন, যারা নিরীহ মানুষদের নিয়ে খেলবে তাদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
বন বিভাগের জায়গায় সিন্ডিকেটের অবৈধ বস্তি
বন বিভাগের পাহাড়ের নিচে আনাচে-কানাচে রোহিঙ্গা বস্তি নির্মাণের নামে জমিদারী শুরু করে ওই সিন্ডিকেট। ঘর প্রতি নেয়া হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। অভিযোগ উঠে ওই সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মী। অভিযোগের তালিকায় বাদ জায়নি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নামও।
মানুষের মত গৃহপালিত পশুও ভেসে উঠে সাগরে
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সাগরের কুল ঘেষে গড়ে উঠা শাহপরীর দ্বীপটির অবস্থান। বিনোদন স্পট হিসেবেও সুন্দর্য্যরে তালিকায় রয়েছে ছোট্ট এ দ্বীপটি। সাবরাং ইউনিয়ন থেকে সাগরপাড়ি দিয়ে যেতে হয় এই দ্বীপে। গত কয়েকদিনে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বেশির ভাগ রোহিঙ্গা নাগরিক এই দ্বীপের জেটি দিয়ে এসেছে। তাদের গৃহপালিত গরু, মহিষ ছাগলও অনেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। বোটে করে নিজেদের সঙ্গে গরুকেও রশি দিয়ে বেঁধে এপারে নিয়ে আসা হয়েছে। আসার সময় অনেক গরু পানির স্রোতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারাও গেছে। আবার এমনও হয়েছে মিয়ানমারে ফেলে আসা গৃহপালিত এসব পশুকে সাগরে নিক্ষেপও করেছে ওই দেশের নাগরিকেরা। ফলে ভাসতে ভাসতে মৃত গরুগুলো এপারে এসে ভেসে উঠেছে। শাহপরীর দ্বীপজুড়ে মরা গরুর দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
শাহপরীর দ্বীপের চারদিকে তখন চোখে পড়তো গরুর শত শত মৃত দেহ। মৃত গরু পঁচে-গলে প্রতিনিয়ত চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ভেসে উঠা চরে খেলতে গিয়ে শিশুরাও অসুস্থ হওযার সম্ভাবনা রয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের চর ঘুরে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল মনছুরের সাথে কথা হয়। তিনি পেশায় একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। তিনি বলেন, শুধু মরা গরু নয়, আপনি ভোরে আসলে এখানে মৃত মানুষের দেহ দেখতে পেতেন। জেটির পাশে একটি মহিলার লাশ ভেসে উঠেছে। পরে পুলিশ এসে মৃত দেহটি নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, এখানে কারও কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তারা শুধু ব্যস্ত থাকে নিজেদের কাজে। মরা গরুগুলোর পাশে ফুটবল খেলছিল কিছু যুবক। তাদের পাশে খেলা করছিল কিছু শিশু-কিশোর। মুহিত নামে একজন জানান, আমরা প্রতিদিন এখানে খেলতে আসি। কিন্তু খেলতে পারি না। মরা গরুর গন্ধে এখানে খেলা করা সম্ভব হয় না।
স্থানীয় চেয়ারম্যান নুর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা কোন দিক সামাল দেব। রোহিঙ্গাদের জায়গা দেওয়াসহ তাদের সব ব্যবস্থা করে দিতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমি লোকদের খবর দিয়েছি, যাতে কোঁদাল দিয়ে গর্ত খুড়ে মরাগরুগুলো মাঠিতে পুতে ফেলা হয়। এদিকে শুধু ওই চরে নয় দ্বীপের অনেক জায়গায় তখনো মরাগরু ছাগল ভেসে উঠছে বলে জানা যায়।
হাতির আক্রমনে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বন্য হাতির আক্রমণে শিশুসহ দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। ভোররাতের দিকে এ ঘটনা ঘটে। সকালে ঘটনাস্থল থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে রোহিঙ্গাদের পরিচয় জানা যায়। তারা হলেন- মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ফকিরাবাজার এলাকার শামসুল আলম (৫৫) ও তিন বছরের শিশু ছৈয়দুল আমিন।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের জানান, উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। নতুন আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের জন্য বনজঙ্গল কেটে ফেলছে। ভোররাতে বন্য হাতির দল রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করে। এ সময় অনেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু শিশুসহ ওই রোহিঙ্গা হাতির পায়ের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। (চলবে)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)