সিডনির কথামালার প্রথম অংশ লিখে পাঠিয়েছি। আজ দ্বিতীয় অংশ লিখতে বসে বড্ড ভাবনায় পড়েছি সিডনির কি বৈশিষ্ট নিয়ে এই দ্বিতীয় অংশটাকে সাজাবো। প্রথমে লিখেছি প্রবীর মৈত্রের বাড়িটি নিয়ে। ছিল জনসংখ্যার স্বল্পতা, প্রাইভেটকারের আধিক্য ইত্যাদি নিয়ে। বাড়িটার কাহিনীতে সামান্য ভুল ছিল যা প্রবীর লেখাটা স্ক্যান করার সময় তার অফিসে বসে দেখেছে। এবং পরে আমাকে বলেছে। তিনটি গাড়ির মধ্যে দুটি গাড়িই নগদ দামে কেনা যা আমি লিখেছিলাম ব্যাংক লোনের মাধ্যমে কেনা হয়েছিল। একটি গাড়ি যেটা আমার নাতনী ইসিতা(বাঁধন) কিনেছে সেটি ব্যাংক লোনে কেনা যার এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধাংশ এ যাবত শোধ হয়েছে। এটি অতি সাধারণ একটি ভুল হলেও সংবাদপত্রে নির্ভুল তথ্যই যাওয়া উচিত ছিল তাই সংশোধন করলাম।
অপর ভুল, লেবার পার্টির প্রধান নেতৃত্বে কমিউনিষ্টরা থাকাকালে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষদের জন্য লড়াই করে উচ্চহারে নিম্নতম বেতন আদায়ের লড়াই সংক্রান্ত তথ্যটি। না এটি লেবার পার্টির নেতৃত্বেই ঘটেছিল তবে কমিউনিষ্টরা পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে জন্ম নিয়ে ১৯২৫ সালে রুশ বিপ্লবের মহান অনুপ্রেরণায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে নিজস্ব নামেই। কিছু কাল অবশ্য কমিউনিষ্টরা লেবার পার্টির অভ্যন্তরে থেকেই কাজ করেছে কারণ শ্রমিক সংগঠন বা শ্রমজীবীদের ট্রেড ইউনিয়নগুলি এবং তাদের ফেডারেশনগুলি প্রায় সবই লেবার পার্টির নেতৃত্বাধীন এবং দলটি অষ্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল।
তাই লেবার পার্টি ও কমিউনিষ্ট পার্টির বিষয় বাদ দিয়ে সিডনির কথামালা কখনোই পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে পারে না। আমার ইচ্ছে, সিডনির কথামালা সিডনির সকল রূপ বৈশিষ্ট্যকেই সাধ্যমতো তুলে ধরুক। তার সকল বৈশিষ্ট্য তো দূরের কথা তার সিকিটাও যদি তুলে ধরতে পারি আর তা যদি আমার প্রিয় পাঠক পাঠিকাদের কাছে সমাদৃত হয় তারা যদি সেটা ধৈর্য্য ধরে পড়েন তবেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করবো।
ইচ্ছে আছে এ বছরটাই এই কথামালা লিখে চলবো আর মাঝে মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে লিখবো কারণ বাংলাদেশ ও তার রাজনীতিই আমার জীবনের মূল অনুপ্রেরণা। সাংবাদিকতা? হ্যা। তার জীবনও আজ দীর্ঘ ৬৫ বছরের যদিও তারও মূল উপজীব্য প্রথমে পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ রাজনীতি। যার প্রত্যক্ষ দৃষ্টিই শুধু নয় অনেকাংশে অন্যতম স্রষ্টাও বটে।
প্রথম অংশে কথা দিয়েছিলাম সিডনির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যা প্রবীর ইন্টারনেট থেকে প্রিন্ট করে এনে দিয়েছে তাই নিয়ে লিখবো। সুতরাং সেটা দিয়েই শুরু করছি। তবে আরও সামান্য একটু ভুল অতীতে করে ফেলেছি। প্রবীরের নির্মিত বাড়িটি নিয়ে সামান্য কিছু কথা লিখতেই হচ্ছে। এর নীচতলায় দুটি উপরতলায় দুটি বাথরুম। সামনের আঙ্গিনায় কার পার্কিং ছাড়াও রয়েছে একদিকে একটা গোলচত্ত্বর, অপর দিকে লেটার বক্স, ছোট একটি ফুলবাগান যাতে আমরা যখন এসে পৌঁছাই তখন চমৎকার ও বৃহৎ কয়েকটি গাছে লাল গোলাপ ফুটেছিল। দেখতেও খুবই চমৎকার। কিন্তু আমরা কি ভাবতে পারি ঐ ফুল গাছে কেউ বাইরে থেকে এসে হাত দেয় না? একটা ফুলও কেউ তুলে নেয় না? প্রতিবেশিদের বাড়ির অন্যান্য বহিরাঙ্গনেরও একই দৃশ্য যদিও আদৌ কোনো দেয়াল বা প্রাচীর নেই। সাদা ফুলও দিবি ফুটে আছে অন্তত: পাঁচটি গাছে।
বাড়ির পেছনটায় রয়েছে কিছুটা বড় মাঠ। তাতে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম বিশাল দুটি মিষ্টিকুমড়ার গাছ যেন নিশ্চিন্তে চুপচাপ সারা শরীর বিছিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছে। তার পাতাগুলি অনেক বড় বড় প্রতিদিনই দু-তিনটা হলুদ ফুল ফুটে ওঠে ইচ্ছে করলেই তা ছিঁড়ে নিয়ে চাকভাজা খাওয়া যায়। কিন্তু কেউ হাত দেয় না। ও থেকে বেশ কয়েকটা বাংলাদেশের জাতের মিষ্টি কুমড়া ধরে আছে যা তোলা হবে পেকে লাল হয়ে যাবার পর। একটি কাঁচালংকার গাছ দাঁড়িয়ে আছে তাতে অসংখ্য ছোট ছোট ফুল যার কোনোটা থেকে মরিচ বেরুচ্ছে। এগুলো তুলতে হয়তো আরও মাস দুয়েক লাগবে। স্বাদে ভালো বেশ ঝালও বটে।
আছে দু’তিনটা আম গাছ যাতে ফল ধরতে সম্ভবত: আরও ৩/৪ বছর লেগে যাবে কারণ এখানে সবই আঁটি থেকে মাটিতে গজানো চারা এখানে আমের কলম পাওয়া যায় না। অপরদিকে আছে একটা সাদা অজানা ফুলের গাছ। তাতেও দিব্যি ফুল ফুটে আছে। মাঝে মাঝে স্ত্রী পূরবী তা থেকে দু’একটা ফুল তুলে এনে পূজা করেন। কয়েকটি তুলসী গাছও আছে। এখানে এখন শীতের শুরু শীঘ্রই হয়তো শীতের তীব্রতা বাড়বে গাছের পাতা ঝড়ে পড়তে শুরু করবে।
এরপরের দফায় লিখবো সিডনি প্রবাসী বাঙালির সামাজিকতা ও তাদের সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে। তা থেকেও দেশে আমরা বেশ কিছু শিখতে পারবো। এখানে দুটি ঋতু, শীত ও গ্রীষ্ম। এখন শীত শুরু হতে চলেছে। অল্প অল্প শীত পড়তেও শুরু করেছে এর মধ্যে। মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ সামান্য পরিমাণে বৃষ্টি ঝড়ে। মিনিট কয়েক ঝড়েই বন্ধ হয়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে গ্রীষ্ম শুরু হবে চলবে পরবর্তী এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
বৃটিশ ক্রিমিনালরা দাবি করে যে বিশ্ববাসীর সাথে সিডনির যোগাযোগ ঘটে যখন ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক প্রথম প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে পর্তুগাল ও চীনের জাহাজ বহরে চড়ে এসে অবতরণ করেন। তখন থেকেই সিডনি শহরের বহু দূরে ২৬ জানুয়ারি ১৭৮৮ তারিখে পোর্ট জনসনে অবতরণ করেন এগারোটি জাহজের এক বিশাল বহর, যার যাত্রীরা ছিল বৃটিশ। তাদের লক্ষ্য ছিল সিডনি শহর নির্মাণ নয় তবে একটি বিশাল কারাগার নির্মাণ যাতে বৃটিশ ক্রিমিনালরা থাকতে পারে নির্বাসনে এসে। বৃটিশ সেনা এবং এদের সাথে ঐ বছরে আগত কিছু সংখ্যক সাজাপ্রাপ্ত বৃটিশ কয়েদীরা মিলে ইউরোপীয় প্রযুক্তি অভিজ্ঞতা নিয়ে অস্থায়ী বসতি কোনোরকমভাবে নির্মাণ করার লক্ষ্যে এসে পৌঁছায় সিডনিতে। তারা স্থানীয় আদিবাসীদের কর্মকৌশল ও নির্মাণশৈলীকে অবজ্ঞা করে ঐ কাজ শুরু করে দেন। অথচ তারাই এখানকার দীর্ঘস্থায়ী প্রাচীনতম বাসিন্দা। এবং বৃটিশ বন্দীরা নানা ব্যাধি নিয়ে আসায় ঐ আদিবাসী স্থায়ী বাসিন্দারা তাদের সংস্পর্শে এসে নানান ইউরোপীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বহু এলাকায় নতুন বসতি প্রায় অনাহারের সম্মুখীন হয়েছেন। এবং খুঁজলে তেমন অবস্থার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। তবে অনেকদিন আগেই সিডনি নগরটিতে অল্পস্বল্প পথঘাট তারা নির্মাণ করেন।
পরবর্তীতে সিডনি নগর বিভক্ত হলো পূর্ব সিডনি ও পশ্চিম সিডনিতে। পূর্ব সিডনি সমৃদ্ধ হলো আধুনিক শহর হিসেবে যাতে সরকারি অফিস, আদালত, গভর্নর ভবন ও পার্লামেন্ট ভবনও পরে নির্মিত হয়। পশ্চিম সিডনি মূলত: ছিল পুরোপুরি অবাধ্য ও ভাঙ্গাচোরা পাথরে নির্মিত রাস্তায় এবং এগুলি এখনও সাক্ষ্য দেয় অতীতের ছোট ছোট আবাস পৃষ্টের অস্তিত্বের। এখানে একটি ভিন্ন ধরণের সমাজ গড়ে ওঠে। এখানে বৃটিশ কয়েদীরা তাদের নির্বাসিত জীবনে যত ভালো নির্মাণ সম্ভব ছিলো তা তাদের শ্রম ও ঘাম দিয়ে গৃহকটেজ প্রভৃতি নির্মাণ করেন, বসতি গড়ে তোলেন। নাবিকেরা যারা মাসের পর মাস সমুদ্রে জাহাজে ভাসমান জীবনযাপন করেছেন তারা ছোট ছোট কটেজ নির্মাণ করেন। সেগুলি এখন মূলত: মদ্যপায়ীদের আবাসস্থল হিসেবে এখানে সেখানে বিরাজ করছে।
কিছু সংখ্যক উন্নতমানের দালানকোঠা নির্মাণ করেন আদিবাসীরা ও সাজাপ্রাপ্ত বৃটিশ কয়েদীরা যখন এখানে গর্ভনর হিসেবে চাকরি করতেন ল্যাকলান ম্যাকুয়ারি ১৮১০ ১৮২১ আমলে। ম্যাকুয়ারি চেয়েছিলেন একটা আধুনিক নগরীতে সিডনিকে পরিণত করতে কিন্তু তাকে লন্ডনে ডেকে পাঠানো হয় একটি অভিযোগে যে তিনি অত্যধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ফেলেছেন।
কিন্তু লন্ডনের হস্তক্ষেপ সত্বেও সিডনি একটি আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠছিল। মুক্ত বৃটিশ নাগরিকরাও কিছু পরিমাণে আমানত শুরু করলেন, কয়েদীরা কারাজীবন থেকে মুক্ত হতে থাকলো এবং গড়ে উঠতে থাকলো স্কুল, গীর্জা, বিপনী, নাট্যমঞ্চ ও একটি আধুনিক লাইব্রেরি কারাগারের আওতার বাইরে। সাজা মুক্ত দেশান্তরীদের ও নবাগতদের সৃষ্টি অর্থনীতি পরিচালিত হতো শিল্প কারিগর দ্বারা যেমন বিপুল পরিমানে অর্থোপার্জনকারী অস্ট্রেলিয়ার wool শিল্প। ১৮৪০ সালে এসে বৃটেন থেকে কয়েদীদের দ্বীপাস্তরে পাঠানো বন্ধ হয়। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পৌনে দুইশ বছর আগে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)