নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক মোবাশ্বের হাসান সিজার নিখোঁজের হিসেব এখনও মেলেনি। কোথায় আছে, কেমন আছে, কবে ফিরে আসবে, এমন নানা প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষায় আছে সিজারের পরিবার, সহকর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীরা। দেশে-বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সঙ্গে সর্ম্পকযুক্ত, বন্ধুমহলে হাস্যোজ্বল একজন মানুষের এভাবে চোখের আড়ালে চলে যাওয়াটা কষ্টের।
এ বছরের ৭ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছে সে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, নিখোঁজের দিন ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা পৌনে সাতটা থেকে সিজারের ফোন বন্ধ, সন্ধ্যা ৬ টা ৪১ মিনিটে তার ফোনে সর্বশেষ কল এসেছিল, তখন সে বেগম রোকেয়া সরণীর লায়ন্স ভবনের দিকে ছিল। এরপরে আর কিছু জানা যায়নি।
মোবাশ্বের হাসান সিজারের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৪ সালে, দেশের প্রথম অনলাইন সংবাদসংস্থা বিডিনিউজ২৪.কমে কাজ করতে গিয়ে।
একজন জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে সেসময় বিডিনিউজে কাজ শুরু করেছিল সিজার। তার দারুণ চটপটে ও কার্যকর স্বভাবের কারণে তৎকালীন বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন, সম্পাদক রাশেদ চৌধুরি ও চিফ রিপোর্টার জাহিদ নেওয়াজ খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল সে এবং তাদের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করে নিজের অবস্থান ভালোভাবেই জানান দিয়ে আসছিল। মিউজিক ভক্ত ও ভোজনরসিক সিজার হাউজের মধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা আর নানা অম্লমধূরতায় ছিল স্বকীয়। বিডিনিউজে কাজের সময়েই সে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে চলে যায়। এরপরে সে যখন দেশে ফিরে আসে, তখন বিডিনিউজের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। সিজার তখন যুক্ত হয়ে পড়ে উন্নয়ন সংস্থায়, তারপরে আবার অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা, গবেষণা কাজে যুক্ত হওয়া।
বিদেশে থাকার সময়ই আলোচনা.কম নামে একটি আন্তর্জাতিক তথ্য-মতামত প্লাটফর্মও চালিয়েছে সে। সেখানে বিভিন্ন দেশের স্কলার ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে নামকরা লেখকরা তাদের লেখা প্রকাশ করতেন। ২০১৪ সালে ইসরাইল যখন গাজা ভূখন্ডে হামলা চালিয়েছিল, তখন ওই আলোচনা.কমে ‘রাশা এন আবুশাবান’ নামে এক ফিলিস্তিনি নারীর যুদ্ধ ডায়েরি প্রকাশ হচ্ছিল ইংরেজিতে। ফেসবুকে সিজার একদিন নিজে থেকে নক দিয়ে বললো, ‘ভাই, এটা বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করুন। অনেক পাঠক পাবেন।’ আমি ওই ডায়েরি প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলাম। সেসময় সিজারের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এরপরে গত বছর বইমেলায় তার গবেষণা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে পঠিত পেপার নিয়ে বই প্রকাশের আগ্রহের কথা জানতে পেরেছিলাম ফোনালাপে। তারপর থেকে তার ইউল্যাব হয়ে নর্থ সাউথ আর এটুআইয়ের ব্যস্ততা দেখেছি বিভিন্ন সংবাদ ও ফেসবুক পোষ্টে।
দেশে-বিদেশে থাকার সময় সে তার নতুন সহকর্মীদের পাশাপাশি পুরাতনদের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় যোগাযোগ রেখেছে, সামাজিক ও পেশাগত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা করেছে, শেয়ার করেছে তার কর্ম-চিন্তা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক থাকার কারণে সিজারের চিন্তা-কর্ম ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো খুব সহজেই প্রকাশ পেতো। সমাজচিন্তা, রাষ্ট্র, রাজনীতি নিয়ে সিজারের ভাবনা ও অবস্থান ছিল বেশ পরিষ্কার। সিজার তার ফেসবুক প্রোফাইলে খুব সাবলীলভাবে ‘ডিভোর্সড’ স্ট্যাটাসটা দিতে পেরেছিল, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সাহসী মানুষ সহজে দিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ফেসবুকে তার বিভিন্ন পোষ্ট থেকে সংসার-সন্তান নিয়ে তার হতাশা ও উচ্ছাস সহজেই টের পেতাম, আগে থেকে চেনার কারণে।
সিজার নিখোঁজ হবার ৩০ দিন চলে গেছে। সংখ্যায় এই ৩০ খুব অল্প মনে হলেও এই সময়ে তার বাবা-মা, বোন, সাবেক স্ত্রী ও একমাত্র শিশু কন্যার মনে-জীবন যে কী পরিমাণ হিমালয় পর্বত হিসেবে দেখা দিয়েছে, তা ভূক্তভোগী ছাড়া বোঝা সম্ভব না।
সিজার নিখোঁজের পরে সিজারের বোন তামান্না তাসমিন সামাজিক মাধ্যমে যে কষ্টমাখা আকুতি নিয়ে তার ভাইকে ফেরত চাচ্ছে, সবারইকে নীরবে-প্রকাশ্যে কাঁদাচ্ছে। ৪ ডিসেম্বর তামান্না অনেকগুলো প্রশ্ন রেখে ফেসবুকে লিখেছে: ‘মোবাশ্বারকে ফিরিয়ে দিন। বাংলাদেশের অন্য মধ্যবিত্ত পরিবারের মত আমাদের সন্তান, বাবা মার প্রতি ভালোবাাসা প্রকাশ করার জন্য আমরা কখনো বলি না ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। এটা আমাদের রীতিতেও নেই। প্রতিদিনের অঙ্গভঙ্গির মধ্যে আমাদের ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। যেমন: কোথায় আছো ? কখন আসবে? তোমার সব কিছু গোছানো হয়েছে? তোমার ফোনে কি পর্যাপ্ত চার্জ আছে? তোমার কি দুপুরের খাবার হয়েছে? তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, তুমি কি অসুস্থ? কেন ঠিক সময় মত ওষুধ খাওনি? তোমার কোন কিছু লাগলে কল করো। তুমি কি ঠিক মত পেীঁছেছো?’ এই প্রশ্নের জবাব দেবার ক্ষমতা আমার কাছে নেই, কিন্তু কষ্ট পাবার ক্ষমতা অবশ্যই আছে।
গত ২৭ নভেম্বর ছিল সিজারের একমাত্র কন্যা আরিয়ানার ষষ্ঠ জন্মদিন। বাবা-মা একসঙ্গে নেই, এই দীর্ঘমেয়াদি গোপন কষ্টের সঙ্গে নতুন প্রেক্ষাপটের মুখোমুখি শিশু আরিয়ানা। এই প্রথম তার জন্মদিনে সে তার বাবাকে কাছে পায়নি সে। এখনও আরিয়ানা জানে না, তার বাবা কবে আসবে, কখন আসবে।
সিজারের এই অবস্থায় তার সাবেক স্ত্রীও চুপ থাকতে পারেনি, সামাজিক মাধ্যমে সে যে খোলা চিঠি লিখেছে তা কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে অনেককে। মেয়ের প্রতি সিজারের ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, মেয়ের অসহায়ত্ব সবই ফুঠে উঠেছে ওই চিঠিতে। সিজারে অনেক সহকর্মী সেই কষ্টে নিজেদের সামিল করে, সিজারের সন্তানের জায়গায় নিজের সন্তানকে দাঁড় করিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের আকূতি ফুটিয়ে তুলেছে। মানববন্ধনে দাড়িয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে কলাম লিখেছে সিজারের সহপাঠী, সহকর্মী ও বন্ধুরা। এরচেয়ে বেশি আর কী করতে পারে তারা! কারণ একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে বের করার দায়িত্বতো আসলে রাষ্ট্রের।
সিজারের নিখোঁজ হবার পর থেকেই সক্রিয় দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে নানা তথ্য জানিয়েছেন। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, ‘মোবাশ্বার হাসান সিজার যেকোন সময় ফিরে আসতে পারেন।’ তার এই বক্তব্যের পরে আশাবাদী হয়েছিল সিজারের পরিবার ও সহকর্মীরা।
কোনো ঘটনা ফলোআপ করতে ২৪ ঘন্টা, ৪৮ ঘন্টা নয়তো ৩০ দিন, ১০০ দিনের মাইলফলক নিয়ে কাজের রেওয়াজ চালু আছে গণমাধ্যমে। সিজার নিখোঁজের ৩০ দিনেও বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেসব সংবাদে আবারও পরিবারের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের অবস্থান ও ঘটনা সর্ম্পকে শেয়ার করারমতো সর্বশেষ তথ্য জানিয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবে এখনও প্রণিধানযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। আর পরিবার জানিয়েছে তাদের হিমালয় পরিমাণ কষ্টের কথা।
সামাজিক মাধ্যমসহ কিছু গণমাধ্যমে সিজারকে নিয়ে নানা নেতিবাচক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যা আবার সামাজিক মাধ্যম গুজব ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিতও হয়েছে। তারপরেও যদি কিছু থেকেই থাকে, তা আমলে আনতে গণতান্ত্রিক দেশের আইন আছে। আসলে এই বিষয়গুলো অবশ্যই কোনো মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমের ট্রায়ালে বিচার বা নির্ধারণ/খণ্ডন করা উচিত নয়, আইনসম্মততো নয়ই।
৭ নভেম্বরের পর থেকে নিখোঁজ মোবাশ্বের হাসান সিজার ফিরে আসুক, সিজারের মেয়ের মায়াময় মুখ আর পরিবারের অসহায় সদস্যদের আকূতি ফিরিয়ে আনুক সিজারকে। এরকম অবস্থার মুখোমুখি যেনো আর কাউকে বা কোনো পরিবারকে হতে না হয়। একজন সাধারণ নাগরিক ও সিজারের সাবেক সহকর্মী হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে এই দাবি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)