পাকিস্তান, ভারতের পর থাইল্যান্ডকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। তাতে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন সালমা খাতুনরা। টিম টাইগ্রেসের অবিস্মরণীয় সাফল্য এমন সময় এলো, যখন আফগানিস্তানের বিপক্ষে খাবি খাচ্ছে সাকিব-মাহমুদউল্লাহরা। সেই হতাশার মেঘ সরিয়ে ক্রিকেটাঙ্গনে সালমা-রুমানারা এনে দিয়েছেন আনন্দের উপলক্ষ।
এশিয়া কাপের ইতিহাসে ভারত প্রথমবার হার দেখেছে র্যাঙ্কিংয়ে ৫ ধাপ পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের মেয়েদের বিপক্ষে। পাকিস্তানও শক্তিশালী দল। সেজন্য আনন্দ, গর্বের প্রকাশটা একটু বেশিই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যার প্রকাশ ঘটছে। দেরাদুনে হতাশায় ঢাকা দলের কয়েকজন ক্রিকেটারও নারী দলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কুয়ালালামপুর থেকে সালমা-জাহানারা-রুমানারা ফেসবুকে ছবি পোষ্ট করে ভাগ করেছেন নিজেদের সেরা সাফল্য উদযাপনের মুহূর্ত।
এমন সাফল্যের পর নাজমুল হাসান পাপন মেয়েদের বেতন-ভাতা বাড়ানো আর বোনাসের সুখবর দেবেন বলেই মনে হচ্ছিল। কারণ বুধবার সন্ধ্যায় নিজের গুলশানের বাসায় সংবাদকর্মীদের ডেকেছিলেন বোর্ড সভাপতি। তবে সেখানে সাকিব-তামিমদের ব্যর্থতার নানা কারণ ব্যাখ্যা করলেও কোনো সুখবর শোনাতে পারলেন না সালমা-রুমানাদের জন্য। অবশ্য মেয়েদের সাফল্যের অনুভূতি জানতে চাইলে বিসিবি বস আনন্দে উদ্বেলিতই হলেন।
‘পাকিস্তানকে হারিয়েছে শুনে ভালো লাগছে। ভারতকে হারানোয় আরও ভালো লাগছে। কারণ নারী দলের জন্য আমরা নতুন কোচ নিয়েছি। নারী ফিজিও নিয়েছি। ভালো সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছি। সমস্যা ছিল ব্যাটিং, তা না হলে দল খারাপ না। আজ দেখলাম ভালো ব্যাট করেছে। অত্যন্ত শক্তিশালী দল ভারত। এটা ভালো দিক। আমাদের আসলে অনেকদূর যেতে হবে। ছেলেদের ক্রিকেটেও, মেয়েদের ক্রিকেটেও। নতুন কিছু প্লেয়ার দরকার।’
বোর্ড সভাপতি উচ্ছ্বসিত, সংবাদকর্মীদের কৌতূহল তখন সালমা-রুমানাদের বেতন ভাতা বাড়ছে কিনা জানতে! প্রসঙ্গ উঠতেই বিসিবি সভাপতি যে যুক্তি দেখালেন তাতে অবশ্য নতুন কোনো প্রশ্ন করারই সুযোগ থাকল না।
‘আপনি কার সঙ্গে তুলনা করছেন সেটা বললে বুঝতে পারব। বিরাট কোহলি যা পায় ভারতের নারী দলের অধিনায়ক তা পায় না। দেখুন গিয়ে, আমি লিখে দিতে পারি।’
নাজমুল হাসান সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমার তো মনে হয় সৌম্য, ইমরুলরা যা পায়, অলমোস্ট কাছাকাছি। ওরা হয়ত পায় ৩০-৪০-৫০ হাজার টাকা, তারা পায় ৭০ হাজার। এইতো? এখন যদি বলেন সাকিব কত পায়, মাশরাফী কত পায়, তামিম কত পায়, ওইটা বেশি হতে পারে।’
মেয়েদের জাতীয় লিগে ম্যাচ ফি মাত্র ৬০০ টাকা, সেটি মনে করিয়ে দেয়ায় নাজমুল হাসান বললেন, ‘ম্যাচ ফি আলাদা হতে পারে। আগে তো ছিলই না কিছু। ‘এ’ ক্যাটাগরির একজন মেয়ের বছরে ৭-৮ লাখ টাকা আয় হয়। এটা কম। কিন্তু অতো কম না।’
সৌম্য-ইমরুলরা প্রিমিয়ার লিগ খেলেই পান ২৫-৩০ লাখ টাকা। বিপিএল খেলে আয় করেন এর কাছাকাছি অর্থই। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, জাতীয় লিগ ও বিসিএলে ম্যাচ প্রতি পান প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা করে পান তারা। এছাড়া জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ প্রতি পান এক লাখ টাকার মতো (তিন ফরম্যাটের গড়)। সেখানে মেয়েরা ম্যাচ ফি পান ১০ হাজারেরও কম। সবমিলিয়ে বছরে কোটি টাকার কাছাকাছি আয়ের সুযোগ থাকে বিসিবির চুক্তিতে না থাকা ছেলে ক্রিকেটারদেরও। চুক্তিতে থাকাদের আয় তো আরও বেশিই। সেখানে বোর্ড সভাপতির দেয়া তথ্যমতে মেয়েদের শীর্ষ ক্রিকেটারের আয় বছরে ৭-৮ লাখ। মেয়েদের আয় ছেলেদের আয়ের কমপক্ষে দশগুণ কম হওয়ার পরও সেটিকে উপযুক্তই মনে করছেন দেশের ক্রিকেটের এ অভিভাবক।
বিসিবির উইমেন্স উইংয়ের চেয়ারম্যান শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল অবশ্য কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে মেয়েদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর ব্যাপারে প্রস্তাব করার বিষয়টি। পারফরম্যান্স ভালো হলে প্রস্তাবের পক্ষে জোর বাড়ে বলে জানিয়েছিলেন। অথচ ইতিহাসগড়া সাফল্য এনে দেয়ার পরও বর্তমান বেতনের পক্ষেই যুক্তি বিসিবি সভাপতির!
‘শুধু অভিনন্দনই যথেষ্ট নয় ওদের জন্য’
ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ দল যে কত বড় সাফল্য বয়ে এনেছেন দেশের জন্য, সেটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে তুলে ধরেছেন বিডিনিউজ২৪.কমের সিনিয়র ক্রিকেট করেসপনডেন্ট আরিফুল ইসলাম রনি। তার বিশ্লেষণী স্ট্যাটাসে ফুটে উঠেছে বৃহৎ চিত্রটা-
‘‘মেয়েদের এশিয়া কাপ আগে ৬ বার হয়েছে। ৬ বারই চ্যাম্পিয়ন ভারত। কোনোবারই একটি ম্যাচও হারেনি.. গত বছর ইংল্যান্ডে ওয়ানডে বিশ্বকাপে রানার্সআপ ভারত। চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি অল্পের জন্য। বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত বড় দল। আর এশিয়ার ক্রিকেটে প্রবল পরাক্রমশালী। অপ্রতিরোধ্য। একরকম অপরাজেয়.. সেই দলকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বেশ দাপটে হারিয়েছে.. অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী ক্রিকেট তো কতবারই হয়েছে। এটিকে রাখতে হবে একদম প্রথম দিকে।
নিজের কথা বললে, আমি ভাবতে পারিনি। সুদূরতম কল্পনাতেও না। আগের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানোর পরও না। আজকে দল যখন জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, শেষে গিয়ে ঠিক কোনো ভজঘট পাকাবে। হয়নি। এভাবে ভুল প্রমাণিত হওয়া দারুণ আনন্দের! ভারত ধরাছোঁয়ার বাইরে বলেই শুধু নয়, জয়টি অভাবনীয় জয়ের ধরণের কারণেও। লক্ষ্য ছিল ১৪২। এত রান তাড়া করা তো দূরের পথ, টি-টুয়েন্টিতে সব মিলিয়েই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল কেবল ১৩৭। মেয়েরা আজ(বুধবার) নিজেদের ছাড়িয়ে গড়েছে নতুন ইতিহাস।
পরপর দুই ম্যাচে বাংলাদেশ হারাল বর্তমান রানার্সআপ ও চ্যাম্পিয়ন দলকে। তবে শুধু ভারত-পাকিস্তানই নয়, বাংলাদেশের মেয়েদের অদৃশ্য প্রতিপক্ষ ছিল আরও। সরাসরি বললে, নিজেদের বোর্ড। বোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গি। জাতীয় লিগের ম্যাচ ফি ৬০০ টাকা নিয়ে কিছুদিন আগে তোলপাড় কম হয়নি। সেটা ছিল দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রমাণ। ঘরোয়া ক্রিকেট হয় না নিয়মিত। এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ হয়নি, হবেও না নিশ্চিত। নিয়মিত নেই ক্যাম্প, ট্রেনিং। মাসের পর মাস বসে থাকতে হয় বেকার, খেলা আর ট্রেনিং শুরুর অপেক্ষায়। নাই কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। নাই ভাবনা। স্রেফ খেলাতে হয় বলে খেলানো হয়।
এই যে কদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেল মেয়েরা, ১৪ মাস পর সেটি ছিল মেয়েদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ। টানা ১৪ মাস, ভাবা যায়..! ওই সফরে আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি খেলেছিল ১৭ মাস পর..! ঘরোয়া-আন্তর্জাতিক, কোনো খেলা নেই। দলটা উন্নতি করবে কিভাবে! বোর্ড শুধু বলে টাকা নেই। মেয়েদের ক্রিকেটে তো শুরুতে টাকা আসবেই না। অন্যান্য খাত থেকে এত এত টাকা বোর্ডের, সেখান থেকেই তো বিনিয়োগ করতে হবে মেয়েদের ক্রিকেটে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারত এভাবেই উন্নতি করেছে। আমাদের বোর্ডের টাকার অভাব নেই, কিন্তু মেয়েদের ক্রিকেটের বেলায় টাকা নেই।
দল খুব বেশি এগোতে না পারায় অনেক ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদেরও দায় আছে। তবে বোর্ড আর সিস্টেমের দায় এত বেশি যে ক্রিকেটারদের দায়টুকু বলাই দায়! মিডিয়ার একজন হিসেবে, আমাদের দায়টুকুও মেনে নিচ্ছি। আরেকটু বেশি গুরুত্ব ওদের প্রাপ্য ছিল।
তো সেই সিস্টেম, সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে আশা করি বড় একটা নাড়া এবার দিতে পেরেছে মেয়েরা। পরপর দুই ম্যাচে ভারত-পাকিস্তানকে হারানো যেকোনো মানদণ্ডেই অবিস্মরণীয় সাফল্য। আর ভারতের বিপক্ষে জয়টি, আবারও বলছি, ছেলে-মেয়ে মিলিয়েই আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্পেশাল জয়গুলির একটি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর মতো এই জয়টিও আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসে একটি মাইলফলক জয় হয়ে থাকবে। শুধু অভিনন্দনই যথেষ্ট নয় ওদের জন্য’’
‘ছেলেদের ম্যাচ হলে সারাদিন ধরে উৎসব চলার কথা’
কুয়ালালামপুরে এশিয়া কাপ কাভার করছেন ভারতীয় কনটেন্ট রাইটার (নারী ক্রিকেট) সুভাম মাইটি। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের দাপুটে জয় দেখার পর ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন তার উপলব্ধির কথা।
‘‘ওরা আবেগপ্রবণ। ক্রিকেট পাগল। অনেকদিন ওদের কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছি, স্টুয়ার্ট বিনি, ধোনি বা কার্তিক, কারণ যাই হোক না কেন ওরা হেরেছে, গালাগাল করেছে, পাগলামি করেছে, কিন্তু পরেরদিন আবার মাঠ ভরিয়ে দিয়েছে।
ক্রিকেটকে নিয়ে নয়, ক্রিকেটেই বেঞ্চে থাকার রসদ পায় ওরা। বরাবর ভারতকে সমর্থন করেছি। কিন্তু ওরা আমাকে আত্মপরিচয়ের দ্বৈত-নাগরিকত্বের সন্ধানে বাধ্য করে। ওদের ওখানে মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা কেমন আমি জানি না। কিন্তু জানি ওরা এখন সাবালিকা। ওদের মানসিকতায় যে পরিবর্তন দেখছি এই এশিয়া কাপে, তা অভূতপূর্ব। লড়াই করে অনেক দূর এসেছে ওরা। কালকের পাকিস্তানকে হারানো ফ্লুক বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু আজ যেভাবে ওরা মেয়েদের ম্যাচ জিতল, তাতে এটা ছেলেদের ম্যাচ হলে সারাদিন ধরে উৎসব চলার কথা। ছেলেদের ক্রমাগত পরাজয়ের মধ্যেও এই বিজয় ওদের মধ্যে হয়ত এক পশলা আনন্দ এনে দেবে।
জয় পরাজয় নিয়ে ওদের কিছু কোনো মাথাব্যথা নেই। ওরা রোজ মাঠে আসে। হারলেও। ক্রিকেট ওদের জীবনচর্যার সাথে মিশে যায়। সেখানে হেরে যাওয়া থাকে কিন্তু পালানো থাকে না। অনেক বছর আগে এক বাঙালি ১৬ টেস্টের অশ্বমেধের ঘোড়া ধরে ছিল। আর আজ ১১ জন বাঙালি ১৪ বছরের ৩৩ ম্যাচের বিজয় রথ থামাল। অভিনন্দন বাংলাদেশি মহিলা ক্রিকেট দলকে।’’