আমি তখন ভোরের কাগজের রিপোর্টার। আমার নির্ধারিত বিট (কর্মপরিধি) ছিল নৌ, সড়ক ও রেল পরিবহন সেক্টর, বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (সিভিল এভিয়েশন), নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদ। তবে একমাত্র স্পোর্টস ছাড়া অন্য সব ধরনের বিশেষ রিপোর্টই আমি করতাম। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিটের কোনো রিপোর্টার ছুটিতে কিংবা অসুস্থ থাকলে ওই বিটের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট যেমন আমার করতে হতো, তেমনি যেকোনো বিটের বিশেষ রিপোর্টের প্রয়োজন হলে কর্তৃপক্ষ আমার ওপরই চাপিয়ে দিতেন। আমিও হাসিমুখে সে দায়িত্ব পালন করতাম।
আমার ওপর ভোরের কাগজ কর্তৃপক্ষের সে আস্থা ছিল এবং যতোদিন সেখানে কর্মরত ছিলাম, সে আস্থার সম্মান রক্ষা করতে পেরেছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এজন্য ভোরের কাগজ কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সম্পাদক শ্যামল দত্ত, নির্বাহী সম্পাদক সুকান্ত গুপ্ত অলক (বর্তমানে দেশ টিভির নির্বাহী সম্পাদক) ও বার্তা সম্পাদক জহিরুল ইসলাম টিপুর (অকালপ্রয়াত) প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। যতোদূর মনে পড়ছে, তখন ভোরের কাগজের প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন জাহিদ নেওয়াজ খান (বর্তমানে চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক)। তাই এ ক্ষেত্রে আমি তৎকালীন প্রধান প্রতিবেদকের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
তখন ২০০৭ সাল। রাজধানীর সড়ক কার্পেটিং প্রকল্পের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধানী রিপোর্ট করার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। সিটি কর্পোরেশনের এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২০০ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে নেমে তথ্য পেলাম ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় শত কোটি টাকাই লোপাট হয়েছে এবং মেয়র সরাসরি এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
যেহেতু মেয়র সাদেক হোসেন খোকার প্রতি আমার বিশেষ সম্মান ও দুর্বলতা ছিল (এর কারণ এ লেখার নিচের অংশে বর্ণিত), সেহেতু রিপোর্টটি করতে আমি অনীহা প্রকাশ করলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমার অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে দ্রুত রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী, বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য অপরিহার্য। আর এখানেই বিপত্তি শুরু। দেশে তখন ১/১১ এর পরিবর্তিত পরিস্থিতি, জরুরি অবস্থা। মেয়র মহোদয় নিয়মিত নগর ভবনে আসেন না, বাসায়ও নিয়মিত থাকেন না। তাই সাক্ষাত পাওয়া দুস্কর। আবার ফোনে চেষ্টা করেও তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলাম। এভাবে অন্তত তিন দিন কেটে গেলো।
এর মধ্যে আমার পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ভারত যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে গেছে। ভিসা হাতে পেয়ে দুপুরে অফিসে গিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন (আগেই মৌখিকভাবে জানিয়ে রেখেছিলাম) করে বললাম, আমি আজ রাতের বাসেই যেতে চাই। কর্তৃপক্ষ এক শর্তে ছুটি মঞ্জুর করলেন; তা হলো খোকার বিরুদ্ধে রিপোর্টটি আজই জমা দিতে হবে। আমি রাজি হলাম এবং আগে তৈরি রিপোর্টটির সঙ্গে খোকার বক্তব্য জুড়ে দিয়ে বিকাল ৪টা নাগাদ তা বার্তা বিভাগে জমা দিলাম। কিন্তু সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার সরাসরি বা ফোনে এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। তাই এমনভাবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলাম, যাতে তিনি সরাসরি অস্বীকার করতে না পারেন এবং আমিও সরাসরি অভিযুক্ত না হই।
পরের দিন ভোরে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছে হকারের কাছ থেকে এক কপি ভোরের কাগজ কিনে দেখি- রিপোর্টটি লাল হরফে ৬ কলামে লিড নিউজ হিসেবে ছাপা হয়েছে এবং আমার নামেই। একটু চিন্তিত হলাম। আর যাই হোক, ঢাকার মেয়র এবং পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন। এছাড়া বিএনপির বড় নেতা তিনি।
১০ দিন পর দেশে ফিরে অফিসে গিয়ে জানলাম মেয়র খোকার দপ্তর থেকে প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছে এবং তিনি নিজেও টেলিফোনে সম্পাদক মহোদয়কে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে ভোরের কাগজের কোনো রিপোর্টার তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি। এবার আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো প্রতিবেদকের বক্তব্যসহ প্রতিবাদ লেখার। কৌশলি ভাষায় যা লিখে দিলাম তাতে ভোরের কাগজ কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে পরেরদিনের পত্রিকায় হুবহু ছেপে দিলো। অন্যদিকে মেয়র খোকা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন; যা পরবর্তী মসয় তাঁর সঙ্গে আলাপকালে অনুধাবন করেছিলাম। তিনি ফোনে আমার সম্পাদক শ্যামল দত্তর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি (সম্পাদক) বিদেশ থাকায় তা সম্ভব হলো না।
এর ঠিক দু’দিন পর খোকার বিরুদ্ধে আরো একটি দুর্নীতির রিপোর্ট করার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। তিন দিন অনুসন্ধান চালিয়ে রিপোর্টটি তৈরি করলাম এবং মেয়র মহোদয়ের বক্তব্যের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল দিলাম। উনি দু’বার কল রিসিভ না করায় আমার পরিচয়সহ এসএমএস পাঠালাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার মোবাইল ফোনে কল আসলো। আমি রিসিভ করে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে কানে ভেসে এলো- “আমি মেয়র খোকা, তুমিই তাহলে সেই আশীষ? বলো, আজ আবার ফোন করেছো কেনো?”
আমি কোন বিষয়ে কথা বলতে চাই তা উল্লেখ করতেই তিনি মুহূর্তেই বলে ফেললেন, “আমি তোমার বড়ভাই না, ফোন না করে ছোটভাই হিসেবে আমার কাছে চলে আসতে পারো না?” আমি বললাম: “খোকা ভাই, আপনার মুখোমুখি হলে অনেক প্রশ্নই করতে পারবো না, আপনার বিরুদ্ধে রিপোর্টও করতে পারবো না। সে ক্ষেত্রে আমার চাকরি নাও থাকতে পারে। কারণ আমি অনেক শ্রদ্ধা করি আপনাকে।” কেনো শ্রদ্ধা করি- তা জানতে চাইলেন খোকা।
আমি বললাম, “খোকা ভাই, আপনি শুধু একজন মেয়র কিংবা বড় দলের বড় নেতা নন। আমার কাছে আপনার পরিচয় ভিন্ন। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনি দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানই নন; আরো অনেক বড় কিছু।” খোকা ভাইয়ের আবার প্রশ্ন- কেনো?
আমি বললাম, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে যে ক’জন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা জীবন বাজি রেখে খোদ ঢাকা শহরে থেকে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরোচিত লড়াই করেছেন, তাঁদের অন্যতম একজন আপনি। আপনাদের টিমে আরো ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের দুই ছেলে প্রকৌশলী রুমী ও জামি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, নিউ এজ পত্রিকার প্রকাশক শহীদুল্লাহ খান বাদল প্রমুখ।” উনি চুপ করে শুনতে লাগলেন।
এরপর আমি বললাম, “আপনাকে আরো দুটো কারণে আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি। তাহলো মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর রাজধানীর অনেকগুলো সড়কের নামকরণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করেছেন; সে ক্ষেত্রে দলীয় সংকীর্ণতা আপনাকে আটকাতে পারেনি। অন্য কারণটি হলো- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আপনি সবসময়েই শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলে উল্লেখ করেন। বিএনপির বড় নেতা হয়ে, বিএনপি সরকারের একাধিকবার মন্ত্রী হয়ে, বিএনপির মনোনয়নে মেয়র নির্বাচিত হয়ে জাতির জনক শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্মোধন করে সৎ সাহসের পরিচয় দিয়ে আসছেন।”
আমার কথাগুলো শুনে খোকা ভাই হয়তো কিছুটা বাকরুদ্ধই হয়েছিলেন। ফোনে বললেন, “তোমার মূল্যায়ন ক্ষমতা অসাধারণ। সবাই কি এসব মনে রাখে বা চিরদিন রাখবে? যা হোক, তোমার কথাগুলো শুনে আমার খুব ভালো লাগলো আশীষ। দেখো, সময়টা তো ভালো না। এসব নিউজ না করলেই ভালো হয়। সবই তো বোঝো। তুমি আমার অফিস বা বাসায় বেড়াতো এসো। সাক্ষাতে কথা বলবো।”
এতো কথা সত্ত্বেও সেদিনই আমি রিপোর্টটি জমা দিয়েছিলাম বা দিতে হয়েছিল। কারণ কর্মের বাধ্যবাধকতা। পরেরদিনই প্রথম পাতায় সে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। তবে রিপোর্টে তাঁকে কৌশলি ভাষায় রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম। এরপর সর্বোচ্চ ৪-৫ দিন খোকা ভাইয়ের সঙ্গে ফোনালাপ হলেও তাঁর বাসা কিংবা অফিসে কখনও যাওয়া হয়নি।
সাদেক হোসেন খোকা আজ সবকিছুর উর্ধ্বে। প্রিয় মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার দীপ্ত শপথে বলিয়ান হয়ে একদিন যে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, আজ সে হাত দুটি নিথর; সমস্ত শরীরও নিথর-নিস্তব্ধ ও প্রাণের স্পন্দনহীন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটি খোকার জন্য অপেক্ষা করছে, সুদূর আমেরিকা থেকে কখন তাঁর পবিত্র দেহখানি আসবে। বাংলা মায়ের এই সূর্যসন্তানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রিয় খোকা ভাই, ওপারে ভালো থাকুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)