গতকাল সোমবার দিবাগত রাত আনুমানিক দেড়টা। কম্পিউটারের সামনে বসে আছি। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার সংবাদ পড়ছি। ফাঁকে ফাঁকে ঢু মারছি ফেসবুকে। ফেসবুক এখন যে কোন সংবাদ মাধ্যমের চেয়ে এগিয়ে। যাদের বন্ধু তালিকায় সাংবাদিকের সংখ্যা যতো বেশী, তিনি ততো বেশী খবর পাবেন। সেটাও অনেকের আগে। এসব খবরের মধ্যে কিছু খবর আমাদের মর্মাহত করে। ভোরের ফোনকল এবং রাতের ব্রেকিং নিউজ কখনও শুভ হয় না। সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে গত রাতে। হঠাৎ এক প্রবাসী বন্ধুর স্ট্যাটাসে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে নিমিষেই। স্ট্যাটাসটি-তে ছিলো একজন মানুষের মৃত্যু সংবাদ।
স্বনামধন্য সাংবাদিক সন্তোষ মণ্ডল নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। স্থানীয় সময় সোমবার (২০ জুন) দুপুরে মারা যান তিনি। মধ্যরাতে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রবাসী সংবাদকর্মী হাসানুজ্জামান সাকী। ২দিন আগেও যার সাথে চ্যাটে আলাপ হয়েছে, সে আজ স্মৃতি। পরলোকের বাসিন্দা। প্রকৃতি সত্যিই বড্ড বেশী নির্মম। ভীষণ নিষ্ঠুর! নিয়তি মৃত্যুর কাছে পরাজিত। ভাগ্যের রুক্ষতায় আদ্রিত। আর তাই মৃত্যুর সংবাদটি প্রচারের সাথে সাথে ব্যথাক্রান্ত হয়েছে বহুজনের হৃদয়। মন ভারক্রান্ত হচ্ছে তাঁর স্মৃতিতে।
২০০৭ সালের কথা। এর আগের বছর বাবার আকস্মিক মৃত্যু। কিছুদিন পরই মায়ের অসুস্থতা। আমি একমাত্র সন্তান। খ্যাতিমান সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির পুত্র। পড়তাম মেডিকেল কলেজে। পাড়াশুনা, খেলাধূলা কিংবা বই পড়া’র বাইরে আমার কোন চিন্তা ছিল না। ছিল না বাস্তবতা সর্ম্পকে কোন ধারণা। বাবা’র হাত ধরে চলতাম। যেখানেই যেতাম আলাদা কদর করা হতো। সেটা যে মেকি তা কখনও মনে হয়নি। বরং মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করতো।
বাবার মৃত্যুর পর বাস্তবতার সাথে আমার পরিচয়। আমার নতুন করে পথ চলা শুরু। ডাক্তারি পড়ার সমাপ্তি। আবার নতুন করে ঢাকায় পড়াশুনা শুরু। পাশাপাশি কাজ। জীবিকার জন্যে। মায়ের চিকিৎসার জন্যে। টাকা দরকার। ডাক্তারি পড়তাম, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তখন মুখ্য ছিলো আমার বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা। একটা চাকরির জন্য দুয়ারে দুয়ারে ধরণা দিয়েছি। যারা এক সময় প্রচণ্ড স্নেহ করতেন তাদের-ই সাংঘাতিক খারাপ ব্যবহারের শিকার হতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে ইয়াত্তার বাইরে।
খ্যাতিমান সাংবাদিক বাবার পুত্র হিসেবে সাংবাদিক মহলের কাছে আমার যে প্রত্যাশা ছিলো সেটায় গুঁড়েবালি পড়েছে খুব অল্প সময়ে। মানুষের আস্থার প্রতি বিশ্বাস কোনভাবেই স্থির থাকেনি। সেটা অবশ্য এখনও নেই! অসময়ে বাবাকে হারিয়েছি। হয়তো এই কারণেই মাকে ধরে রাখার তীব্র প্রয়াস। কি করবো? কোথায় যাবো?
যেখানে-ই যাই, প্রথম ২/১ দিন কথা বলেন। আশ্বাস দেন। এরপর দেখা পাওয়াই দুরূহ। এই পত্রিকা, সেই পত্রিকা, এরকম বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতে থাকি। বাবা সাংবাদিক থাকার সুবাদে পত্রিকার নাম গুলো জানা ছিলো। অফিস চিনতাম না। বাবার সাথে কার বা কাদের সখ্যতা সেটাও জানতাম না। জানার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও। বাসায় অনেকগুলো পত্রিকা আসতো। আমি ২/১টায় শুধু চোখ বুলাতাম। টিভি চ্যানেলের সংবাদ তখনও এতোটা বিকশিত নয়। বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যাও ২/৩টি। চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা এবং একুশে টেলিভিশন।
সংবাদ প্রচারে চ্যানেল আই এবং একুশে টেলিভিশন বাংলাদেশে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। কম কথায় সচিত্র প্রতিবেদন মানুষকে আকৃষ্ট করে। আকৃষ্ট হয় প্রতিবেদকও। আর সেই প্রতিবেদক যদি সমাজের অপরাধ, দুর্নীতি’র চিত্র তুলে ধরেন, তাহলে পাঠক জনপ্রিয়তা অন্যদের চেয়ে বেশী থাকে। যেমনটি ছিল সন্তোষ মন্ডলের।
নিরলস প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মেধার যৌথ সমন্বয়ে চ্যানেল আইয়ের অন্যতম খ্যাতিমান রিপোর্টার ছিলেন সন্তোষ মন্ডল। সংবাদ সংগ্রহে তার সাহসী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি, সমাজের নানাবিধ দূর্নীতির চিত্র নিখুঁতভাবে উপস্থাপন। জেনেছি, এসব দুর্নীতি, অপরাধের অন্তরালে কারা। যেহেতু টিভি মিডিয়া, সেহেতু বহু সন্ত্রাসী, অপরাধী কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চেহারাও টিভিতে দেখেছি। হয়তো মাঝ রাতের কোন ঘটনা, আমরা পরদিন চ্যানেল আইয়ের সংবাদে সন্তোষ মন্ডলের প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। সন্তোষ মন্ডলের খ্যাতির ব্যাপ্তি এতোটা-ই ঘটেছিল, সেই সময় (সম্ভবত ২০০৩ সালে) একটি নাটকেও তাকে সাংবাদিকের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছে। নাটকটি ছিল ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল-এর রচিত এবং পরিচালিত প্রথম ধারাবাহিক।
খ্যাতিমানদের কিছুটা দাম্ভিকতা থাকে। সেটা অস্বভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সন্তোষ মন্ডলের আন্তরিকতা অস্বাভাবিক। সেটার উদাহরণ আমি। মাকে বাঁচানোর আশার, চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি ডিআরইউ আর ক্র্যাব চত্ত্বরে বসে থাকতাম। সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করতাম। এই দুটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠার অন্তরালে আমার বাবা প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জির ভূমিকা রয়েছে।
যেটা এখন যারা সংগঠনের সাথে যুক্ত তারা অনেকেই জানেন না। দিনের পর দিন একবুক আশা নিয়ে যেতাম সেগুনবাগিচার ডিআরইউ আর ক্র্যাব চত্ত্বরে। অনেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বহু আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু কার্যত কেউ কিছুই করেননি। সেই অসহায় মুহুর্তে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন সন্তোষ মন্ডল। তিনি আমাকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার ২টি এয়ার টিকিট জোগাড় করে দেন। ব্যক্তিগতভাবে কিছু ডলারও হাতে গুঁজে দেন।
আমার বাবাকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। যার ধারায় আমিও তার স্নেহ পেয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। অথচ বাবা বেঁচে থাকতে তার সাথে আমার কখনও কথা হয়নি। দেখাও হয়নি। এই আন্তরিকতাকে আমি কি বলবো? অসময়ে যে পাশে দাঁড়ায়, তার-ই তো রয়েছে মনুষ্যত্ব। সে-ই তো মানবিক। তাই নয় কী?
পৈত্রিক নিবাস যশোর ছেড়ে সন্তোষ মন্ডল ঢাকায় এসেছিলেন সাংবাদিকতার ব্রত নিয়ে। জীবনের প্রথম পর্যায়ে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন দৈনিক সংবাদ-এ। এরপর যোগদেন চ্যানেল আই-তে। মূলত চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমেই তিনি একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। চ্যানেল আইয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। এরপর অজ্ঞাত কারণে সরে আসেন সাংবাদিকতা পেশা থেকে। শুরু করেন নিজস্ব ব্যবসা।
টেকনাফে একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। সেটা সম্ভবত লাভজনক হয়নি। আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। এই ফিরে আসা তার জন্য সুখকর ছিলো না। যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজী পত্রিকা ডেইলী সান-এ। সেখানে দীর্ঘদিনের বেতন বকেয়া রেখে তাকেসহ বেশ কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর সাংবাদিকতায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দেশের একটি অনলাইন পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। গত বছর সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিউ ইর্য়ক যান। হয়তো দেশে ফিরে মিডিয়া নিয়ে নতুন কিছু করার স্বপ্ন ছিলো তাঁর। যে স্বপ্নকে অধরা রেখে তিনি নিজেই ঐ জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন।
সাংবাদিক সন্তোষ মণ্ডলের সঠিক মূল্যায়ণ কী হয়েছে? তার মতো তুখোর রিপোর্টারের শেষ দিকে একটি ভালো চাকরি জোটেনি। এক সময়ের তারকা সাংবাদিকের নাম বিলীন না হলেও ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছিল। তবুও জীবিকার তাগিতে সাংবাদিকতায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। এই অবমূল্যায়ন তাকে ঠিক কতোটা দংশিত করতো বা করেছে, সেটা অনুমানের বাইরে।
জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু প্রতিভা? সেটার স্থায়ীকালও কি সীমিত? সাংবাদিক হিসেবে সন্তোষ মণ্ডলের মানদণ্ড নির্ধারণ করার মতো ব্যক্তি এদেশে কমই আছেন। যারা আছেন তারাও নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন।
চোখের সামনে দেখেছি প্রিয়জনদের অকালে চলে যেতে। জীবিত যাদের তোয়াজ করার লোকের অভাব হয় না, মৃত্যুর পর তাদের ভুলে যেতেও সময় লাগে না।
আমরা ভুলে গেছি, সাংবাদিক নির্মল সেন, ফওজুল করিম, প্রফুল্ল কুমার ভক্ত, দীনেশ দাস, সুনীল ব্যানার্জি, মাহবুবুল আলম, মাহবুব মতিন, আতাউস সামাদ, অমল জোহা খান, মিনার মাহমুদ এবং সর্বশেষ মাহফুজুল হক খানসহ আরও অনেককে।
সন্তোষ মন্ডলও এই ভুলে যাওয়ার রীতি’র বাইরে অবস্থান নেবেন না। এটাই যেন স্বাভাবিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও এটা বাস্তবতা। যেই বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যেমনটি নেই সন্তোষ মন্ডলকে বিদায় না জানানোর সুযোগ। বুকে পাথর চেপে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে গুড বাই’ জানাই। সন্তোষ মন্ডলের আত্মার শান্তি কামনা করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত
মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির
সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)