ছোটবেলার বন্ধু বুবাই গৃহশিক্ষকতা করেন। তার বাড়িতে যাতায়াত আছে। সেখানেই সংগ্রামের সঙ্গে প্রথম আলাপ। সংগ্রাম ভট্টাচার্য। ভয়াবহ বাইক দুর্ঘটনার পর যার মস্তিস্কের মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারের মানুষদের ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লানটেশনের সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্ত কার্যকরী হওয়ার পর আমার শহর ভাটপাড়ার সংগ্রাম, এখন গোটা মানবসভ্যতার সংগ্রামের একটি বীজমন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
একটা ছোট লাল রেসিং সাইকেলে রেল রাস্তা ধরে ছেলেটিকে তার মাস্টারমশাই বুবাইয়ের বাড়িতে আসতে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। শান্ত, বিনয়ী, মিতবাক একটি ছেলে। দেখা হলেই তার মিষ্টি হাসিটা এখনও চোখের উপর ভাসে। গড়পড়তা ছাত্র হলেও মানবিক গুণগুলি যথেষ্ট ছিল। কোনো রকম রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সাথে ছেলেটিকে মেলামেশা করতে দেখিনি।একটা ছোট বন্ধুবৃত্তের ভিতরে ছিল। ক্রমে সাইকেলের বদলে বাইকের সাওয়ারী হতে দেখলাম তাকে। বয়সের দূরত্বে অন্তরঙ্গতা না থাকলেও যেহেতু তার মাস্টারমশাইয়ের বন্ধু, ফলে যেখানে দেখা হোক, অল্প হেসে, কুশল সংবাদ নিতে ভোলেনি কখনো। সময়ের গতি তার জীবনের ব্যস্ততা বাড়িয়েছে। ছাত্র থেকে সংগ্রাম উত্তরীত হয়েছে পেশাজীবীতে। আর দশজনের মতো তার জীবনটা একটা পরিচিত ছন্দে বয়েছে। পথেপ্রান্তরে দেখা হয়েছে, তবে মাস্টারমশাইয়ের বন্ধু সুলভ একটা দূরত্ব অথচ পাড়াগত, পরিবারগত সখ্যতার নৈকট্য – দুটোর মাঝখানে থেকে গেছে সম্পর্কটা।
সেই ‘সংগ্রাম’ ই হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।তার দুঃখজনক মৃত্যু আর সেই চিরবিচ্ছেদের পর ও ,পুরনে ন হন্যতে হন্যমান শরীরে, র প্রতি তার পরিবারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত একজন সাধারণ ছেলেকে অসাধারণত্বে কেবল উন্মীলিতই করেনি, একটা চিরস্থায়ী মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। মৃত্যুশোককে অতিক্রম করে একটি পরিবারের সঠিক সময়ে, সঠিক অবস্থানে স্থিত হওয়া এটা কোনো মামুলি বিষয় নয়। বিশেষ করে ভাটপাড়ার মতো একটি প্রতিক্রিয়া আর প্রগতির দোলাচালে থাকা না শহুরে, না মফসসলি জনপদের কাছে যথেষ্ট সঙ্কট উত্তীর্ণ একটি কালপর্ব হিশেবেই চিহ্নিত করা যায়।
বছর পনের, কি আর থেকে বেশি ও হতে পারে, একটি শারদ পত্রিকাতে ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লানটেশন নিয়ে ভারি মনোগ্রাহী একটা গল্প লিখেছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক তথা কথাশিল্পী অভিজিৎ তরফদার। সংগ্রামের জীবনের সমাপন যেন অভিজিৎবাবুর গল্পের ই একটা বেদনা বিহ্বল বাস্তব চিত্র। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয় ঘিরে অভিজিৎবাবুর গবেষণা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত হলেও এই বিষয়টি ঘিরে তিনি তার নিজের রাজ্যে কায়েমী চক্রের অঙ্গুলি হেলনে যথেষ্ট চাপের ভিতরেই কাজ করেন। কারণ, ভারতের অনেক রাজ্যেই সরকারি হস্তক্ষেপ আর জনসচেতনতার দরুণ কিডনি বেচা কেনা প্রায় বন্ধ। কিন্তু কলকাতায় কোনো রোগী যখন শোনেন তার কিডনি খারাপ হয়ে গেছে, ডায়ালিসিসেও বেশি দিন ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না, কিডনি প্রতিস্থাপন জরুরি, তখন রোগীর আত্মীয়ের ডাক্তারবাবুর কাছে প্রথম প্রশ্নটিই থাকে; কিডনির কি রকম দাম পড়তে পারে?
আর সেখানেই অভিজিৎবাবুর আপাত কঠিন মন্তব্য রোগীর পরিবারের প্রতি; অন্য ডাক্তারবাবুর কাছে যান। গোটা ভারতে হাতে গোনা যে দুপাঁচজন চিকিৎসক আছেন, যারা কোনো অবস্থাতেই কোনো চক্রের চক্রবৃত্তিহারে সুদ খাতক নন, ডাঃ তরফদার, তাদের ভিতর বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। তাই কিডনি চক্রের চক্রীদের , তা তারা নিছক দালাল ই হোন, ডাঃ তরফদারের সহকর্মী চিকিৎসক ই হোন, কিংবা রাজনীতির কারবারি, প্রত্যেকের কাছেই চরম অপছন্দের মানুষ তিনি।
সংগ্রামের পরিবার যে ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লাটেশনের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, তার ভিত্তিতেই রয়েছে কিন্তু অঙ্গ প্রতিস্থাপন ঘিরে ডাঃ তরফদারের উদ্যোগে বাংলার বুকে প্রসারিত বিজ্ঞানভাবনার সঠিক আঙ্গিক। এক যুগের ও বেশি সময় আগে যখন অভিজিৎবাবু এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন ঘিরে কিশোর মননোপযোগী গল্প লিখেছিলেন, তখন ও কিন্তু ভারতে এই ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লানটেশন ঘিরে স্বচ্ছ ধারণাই তৈরি হয়নি। অকালপক্কদের ভিতরে এই ধারণার প্রসারণের অপেক্ষা কিশোর, কচি, কাঁচার মনে এই ভাবনাটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ডাঃ তরফদার।
সেই গল্পটা সংগ্রামের মাস্টারমশাই বুবাইকে পড়িয়েছিলাম। গল্পটির স্বাদ থেকে বুবাই তার ছাত্রদের ও বঞ্চিত করেননি। স্কুল ছাত্র থাকাকালীন গল্পটি পড়ে লেখক ডাঃ তরফদারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছের কথা বুবাইয়ের বাড়িতে বসে, কিশোর বেলার ঔৎসুক্যে বলেছিল। সেই ঔৎসুক্যতেই কি সে নবপরিণীতা বধুকে, যদি তার অকাল মৃত্যু ঘটে, তবে যেন অঙ্গ প্রতিস্থাপনে পরিবার উদ্যোগী হন– এমন ইচ্ছের কথা জানিয়েছিল?
গত শতকের চারের দশকে বামপন্থার বিকাশের কালে, নতুন ভাবধারাতে ভাটপাড়া কিছুটা আলোকিত হলেও , সেই আলোকসঞ্চারে বর্ণবাদী সংস্কার আর সেই বর্ণবাদের অবশ্যমম্ভাবী ফল হিশেবে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষের দোলাচালে বিকশিত হয়েছিল। ত্রিকোন প্রেমের জেরে আত্মহত্যা থেকে গান্ধী ভক্ত হওয়ার জন্য নিজের মায়ের উপর প্রগতিশীল ছেলের সামাজিক নির্যাতন, আবার প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে বামপন্থীদের উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন, সেই রবীন্দ্রজয়ন্তী ভেস্তে দিতেই আর এস এসের শাখা সংগঠন ‘ রামরাজ্য পরিষদে’ র হয়ে ভোটে লড়া শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কর্তৃক নিজের ‘ স্নেহভাজন’ দের দিয়ে রবীন্দ্র জয়ন্তীর লাইট কাটিয়ে দেওয়া– এই অসম্ভবরকমের পারস্পরিক সংঘাতের ভিতর দিয়ে এই অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটেছে।
বঙ্কিম, কেশব সেন, হরপ্রসাদ, চশমাবাবার নৈহাটি মনোজগতের চর্চাকে একমাত্র একাদশী, নবমীর খাদ্যাখাদ্য বিচারের ভিতরেই আবদ্ধ করে রাখে নি।কিন্তু স্মৃতিশাস্ত্রের মনুবাদী চেতনাই ভাটপাড়ার সামাজিক বিন্যাসের মূল পরিকাঠামোকে চরম বর্ণভিত্তিক সাম্প্রদায়িক করেছিল। আর এস এস যেমন, বহুত্ববাদী চেতনায় বিশ্বাসী, সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একাত্ম মানুষ কে হিন্দু বলে স্বীকার করে না, ভাটপাড়াও একদিন বশিষ্ঠ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ ব্যাতীত কাউকেই ব্রাহ্মণ তো দূরের কথা, মানুষ বলেই মনে করত না। শ্রীরামকৃষ্ণের উদার, সমন্বয়ী, মানবিক চেতনাকে এই ভাটপাড়ার আদি বাসিন্দা বলে যারা নিজেদের দাবি করতেন, তারা রীতিমতো অপছন্দ করতেন। যে শ্রীজীব ন্যায়তীর্থের কথা বলে হলো, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানকীবল্লভ ভট্টাচার্য এই ভাটপাড়া তে বসেই প্রবল ভাবে হিন্দু মহাসভা করেছেন। শ্রীজীব বাবুর হয়ে ‘৫২ র নির্বাচনে প্রচার কাজে থেকেছেন। দেশভাগের পর্যায়ে বিভাজনের চরম সমর্থক ছিলেন,সেই মানুষটিই পরে হঠাৎ এক সকালে কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন।
জাত্যাভিমান, ব্রাহ্মণ্যবাদ, বশিষ্ঠগোত্রীয় ব্রাহ্মণব্যাতীত নিম্নবর্গীয় হিন্দু, মুসলমান, বাঙাল– সবাইকে এক বন্ধনীতে ফেলতে অভ্যস্থ একটা অংশের লোকেদের কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাক্রম, আর সেই ঘূর্ণাবর্তের গোলচক্করে অর্জুন সিংয়ের মতো নেতার ভরা বাম জামানাতে জেতার রহস্যের চাবিকাঠি, তার ভিতরেই লুকিয়ে আছে ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব, বিরোধের দিকটি। আর সেই প্রতিক্রিয়ার আবেগকে, পরিবার, জীবনের শোকের এই নিচ্ছিদ্র পাথার কে অতিক্রম করে সংগ্রামের পরিবারের এমন অসমসাহসী সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে উনিশ শতকের নবজাগরণের আঙ্গিকের একটি সংস্কার মুক্তি।
‘শ্রীমতী কাফে’ তে কালপর্বের অদলবদলের যে ইঙ্গিত সমরেশ বসু দিয়েছিলেন, তা বারাকপুর শিল্পাঞ্চল শোনেনি। সতর্ক করা যুগ সঞ্চালক সমরেশের কাজ ছিল। যুগ কে বদলে দেওয়া তার কাজ ছিল না। তাই ‘ অমূল্য’ চরিত্রটি আজকের অর্জুন সিংদের মতো লোকদের ইঙ্গিত দিচ্ছে, সেটা বোঝানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত সমরেশ দিয়েছিলেন। সমরেশের কমরেডরা সেই ইঙ্গিত বোঝার চেষ্টাই করেননি। ভজুলাটের জীবনের উত্তরণ, বি টি রোডের ধারে – তে দেখিয়েও শেষ সতর্কতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন সমরেশ। তবু জাতপাত, বাঙালি- অবালি, হিন্দু- মুসলমান, ঘটি- বাঙালের ঘূর্ণাবর্ত থেকে কেউ ভাটপাড়াকে বের করতে চাননি। বাম আমলে শাসনের দাপটে প্রকাশ্যে ছাই চাপা পড়ে গিয়েছিল এই ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত্যাভিমান। কিন্তু ছাইয়ের ভিতরে আগুন যে তীব্র ছিল, ধিকিধিকি নয়, তা বিদ্যুৎ গাঙ্গুলীর রহস্য মৃত্যুর পর ই অর্জুন সিংয়ের জয় আর ধীরে ধীরে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজটা ক্রমে যে খোট্টা সংস্কৃতিকে গাল না পেড়ে জলগ্রহণ করত না, সেই সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তখনকার বাম নেতারা অর্জুনের সঙ্গে পেশিশক্তিতে এঁটে উঠতে ভাটপাড়ার রায় স্টুডিও এলাকাকে ছাপড়া, সিওয়ান, মজফফরপুর জেলার মিলন ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।
অবনীন্দ্রনাথ রাখীবন্ধন উৎসবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ‘হুকুম আয়া’ শব্দটির বহুল ব্যবহার ঘটিয়ে, স্বভাবসুলভ রসিকতায় বলেছিলেন; হুকুমটা দিল কে? ঠিক তেমন ই ‘ হুকুম আয়া’ বেরাদরিতে যখন সবাই কমিউনিস্ট হয়েছিলেন, সংগ্রামের পরিবারে তেমন কিছু ঘটেছিল কি না জানা নেই।তবে একটা প্রগতিশীল ধারা তাঁদের ভিতরে ছিল। ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্টে যাতায়াতের কালে সংগ্রামের পিসী অভা, সাতের দশকে ‘অপরাজিতা’ নাম শুনলে, অশোক ঘোষের স্নেহভাজন অপরাজিতা গোপ্পীর নামটা এককথাতেই বলে দিতে পারতেন। সাইনাসের হাত থেকে বাঁচতে আজকের করোনাকালের মতোই সেকালে তিনি এক কবিনীর মতো মাথায় হিজাবের মতো উষ্ণীষ ও রাখতেন। কমিউনিস্ট নেতা গোপাল বসু যে ভালোবেসে সমরেশ বসুকে ‘তড়বড়ি’ বলে ডাকতেন, সেটাই সংগ্রামের স্ত্রীর এক আত্মীয়ের কাছ থেকে গোপাল বাবুর একটি লেখার পান্ডুলিপি থেকে জানি।
এই সংগ্রাম, কাদের- সেটা ঘিরেও চাপান উতোর চলছে। যেহেতু সে পেশাগত দিক থেকে একটি বামপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাই তাকে নিবেদিতপ্রাণ বামপন্থী বোঝাতে বামপন্থীদের কাগজে চায়ের দোকান থেকে বাইকের স্ট্যান্ড না ফেলার গপ্পো দিয়ে সৎ সাংবাদিকতা বোঝানো হয়েছে। নেতানেত্রীরা তার বাড়ি গিয়েছেন, সেই ছবিতে ছয়লাব ফেসবুক। পিছিয়ে নেই বিজেপিও। তাদের সাংসদের মালিকানাধীন কাগজে সংগ্রামকে স্বয়ংসেবক বানানোর প্রক্রিয়া আর একটু হলেই সম্পন্ন হয়ে যায় আর কি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)