এই অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নিপীড়ন ও তাদের হত্যার ঘটনা নজিরবিহীন নয়। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-মিয়ানমার-শ্রীলঙ্কাসহ এখানকার অনেক দেশেই এগুলো নিয়মিত ঘটনা। ফলে দেশগুলোতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেশ ছাড়তে হচ্ছে, বাস্তুহারা হচ্ছে তারা, হারাচ্ছে প্রাণও।
নিপীড়ন এখানে অনুশীলনের পর্যায়ে, ফলে যেখানে যে জাতি ও ধর্মের লোক সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেই তারা নিপীড়ক সেজেছে, হন্তারক হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো যে সচেতন সেটাও বলা যাচ্ছে না; উলটো রাষ্ট্রীয় প্রত্যক্ষ-মদদে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত এই নিপীড়ন ঘটেই চলেছে।
কেবল এ অঞ্চলেই নয়, সারাবিশ্বে সন্ত্রাসবাদ এখন ভয়াবহ পর্যায়ে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এনিয়ে বৈশ্বিক নানা সংস্থা বিভিন্ন সময়ে কথা বললেও এগুলো কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এর প্রতিবিধানে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, নিপীড়িত হচ্ছে।
বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় দেশ স্বাধীনের পর এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। বর্তমানে এই সংখ্যা কমতে-কমতে সাতে এসে ঠেকেছে। এখানে বড়ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিয়মিত ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন কৌশলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। এর বাইরে আছে প্রতিবছর বিভিন্ন উপাসনালয়ে হামলাসহ নানা ঘটনা। এসব কারণে দেশ ছাড়ছেন হিন্দুরা; অধিকাংশই আশ্রয় নিচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।
ভারতও যে উদার দৃষ্টিতে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে তাও না। এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়। ওখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশটিতে মুসলমানরা আবার সংখ্যালঘু। স্রেফ ‘গরুর কারণে’ ওখানে অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটে। পাকিস্তানের উদাহরণ এখানে না দিলেও হয়। দেশটি ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সেই দেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নিপীড়নের শিকার। এর বাইরে আছে শিয়া-সুন্নি বিরোধ। আর ওসব বিরোধে অগণন মানুষের প্রাণের অপচয় সে নিয়মিত ঘটনাই।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু নিপীড়নের ইতিহাস জানে পুরোবিশ্ব। সর্বশেষ পৌনে দুইবছর আগে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করেছে তারা, প্রাণ বাঁচাতে বিপুল সংখ্যক লোক দেশ ছেড়েছে; আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। আফগানিস্তানে সংঘাতের কাহিনী ত সকলের জানা। শ্রীলঙ্কায় সম্প্রীতির ইতিহাসও সুখের নয়। একদশক আগে ২০০৯ সালে ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধ অবসান হয়, তবু শান্তির সুবাতাস বইছে না।
ধর্মীয় সংঘাত ঘটছে নিয়মিতভাবেই। ক’বছর ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কাজুড়ে যেসব আক্রমণ হয়েছে সেগুলো করেছে বৌদ্ধ সিংহলি কিছু সংগঠন। তবে খ্রিস্টান সিংহলিরা মুসলমানদের ওপর হামলা করেছে সেরকম প্রমাণ পাওয়া যায়না। বৌদ্ধধর্মীয় কিছু সংগঠন চার্চগুলোতে মাঝেমধ্যে প্রার্থনাসভায় হামলা করে থাকে।
শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ তারা। এছাড়া সংখ্যালঘুদের মধ্যে আছেন ৯ শতাংশ মুসলিম এবং ১২ শতাংশ হিন্দু। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ ৭০ শতাংশ। সম্প্রতি খ্রিস্টানদের চার গির্জা, তিন হোটেলসহ আট স্থানে ভয়াবহ হামলার ঘটনায় সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে ৩৫৯ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে, আহত হয়েছেন ৫০০ শতাধিক।
এদিকে, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে এক অধিবেশনে দেশের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুয়ান বিজেবর্ধনে এই হামলা সম্পর্কে বলেছেন, ‘তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ক্রাইস্টচার্চে হামলার প্রতিশোধ নিতেই শ্রীলঙ্কায় এ হামলা চালানো হয়’। তবে স্থানীয় এই সংগঠনটির এতবড় হামলার সক্ষমতা আছে কিনা এ প্রশ্ন রেখে দেশটি এও বলছে, এর পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসূত্র থাকতে পারে। একই কথা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও।
‘এনটিজে’ একা নাকি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী মুসলিম কোন সংগঠন এই হামলা চালিয়েছে তা এখনই পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের হাল আমলের ঘটনাক্রমের দিকে দৃষ্টি দিলে এই হামলায় উগ্রবাদী ইসলামিস্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততাকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করতে হবে। এবং সেটা করাও হচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় অনেকটা আতঙ্কে রয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি। আতঙ্কের পাশাপাশি তারা লজ্জা আর ভাবমূর্তি সঙ্কটেও।
এরইমধ্যে বিভিন্ন মসজিদের সামনে সেখানকার মুসলিমরা হামলার নিন্দা জানিয়ে ব্যানারও সাঁটিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। গির্জাসহ আট স্থানের নারকীয় হামলার ঘটনায় যাদের দায়ী করা হচ্ছে তারা সংখ্যালঘু, আর যারা হামলার শিকার তারাও সংখ্যালঘু; তবে এই হামলায় হতাহতের সকলেই সকল ধর্মের।
নারকীয় এই হামলার লক্ষ্যবস্তু খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ও উপাসনালয় হলেও সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া গির্জা ছাড়াও তিন বিলাসবহুল হোটেলে হামলার ঘটনায় সে প্রমাণ মেলে।
স্রেফ খ্রিস্টানরাই সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য হলে গির্জায় হামলার পর বিলাসবহুল হোটেলগুলোতে হামলা করত না তারা। ফলে ধারণা করা যায়, এই হামলার ঘটনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া। ৩৮ বিদেশিসহ তিন শতাধিক লোকের প্রাণহানিতে প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে উগ্রবাদী গোষ্ঠী। একই সঙ্গে এসেছে তারা বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে।
এই হামলার অব্যবহিত পর যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো এরজন্যে শ্রীলঙ্কান মুসলিম সংগঠনগুলোর অনেকেই নিন্দা জানিয়েছে। আমাদের এখানকার মুসলিমদের চাইতে সেখানকার মুসলিমদের পার্থক্য এখানে। আমাদের এখানে এইধরনের অথবা যেকোনো হামলার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির লোক নানা অজুহাতে সেইসব হামলাকে জায়েজিকরণের চেষ্টা চালায়, কেউ-কেউ চুপ করে বসে থাকে।
ওখানে সেটা হচ্ছে না আপাত। আশা করতে চাই ওখানে সন্ত্রাসবাদের সমর্থকের সংখ্যা কম, খুবই কম; তবে এখনই চূড়ান্তভাবে এর প্রমাণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত কারণ এর বীভৎস প্রকাশ হয় যেখানে সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নজরদারিতে কিংবা বন্ধ।
আটবছর আগে কলম্বোকে দেখেছিলাম। ওই সময়ে দেখেছি কেবল সংসদ অধিবেশনের সময়ে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা শহর। অধিবেশনের সমাপ্তিতে পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও শিথিল। রাত বিরাতে কলম্বোর পথ ধরে হেঁটেছি, কখনই নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়নি। সেখানকার পরিচিতজনেরাও বলতেন কলম্বোতে সমস্যা নাই, নিরাপদ। এটা যতখানি বাস্তবতা তার চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস- বুঝতে পারছি এখন।
ভাবছি, আমার সেই সময়ের পরিচিতদের যারা নিরাপত্তার অভয় দিয়ে কথা বলতেন তারা সংসদ অধিবেশনের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখেও বুঝতে পারতেন না আসলে তারা নিজেদের বিশ্বাসের মত এতখানি নিরাপদ ছিলেন না কোন সময়ই।
হামলার আগে শ্রীলঙ্কার কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল না তা নয়। হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহে জানিয়েছেন, ‘সরকারের কাছে হামলার আগাম তথ্য ছিল, কিন্তু সরকার এই বিষয়ে কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়নি’। কেন নেয়নি কোন ব্যবস্থা এজন্যে নিশ্চয়ই তারা ব্যাখ্যা দেবে। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য ছাড়াও বার্তা সংস্থা এএফপি’র খবরে বলা হয়েছে, গত ১১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার পুলিশপ্রধান পুজুথ জয়াসুন্দরা এক অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সতর্কবাণীতে গির্জায় সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করেছিলেন।
কেবল তাই নয়, ভারত সরকারের এক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এনডিটিভি জানিয়েছে, ‘হামলার বিষয়ে শ্রীলঙ্কাকে আগাম সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হামলার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কাকে ৪ এপ্রিল ও ২০ এপ্রিল দুই দিন সতর্ক করা হয়েছিল’।
তার পরেও এই হামলা প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি দেশটি। গোয়েন্দা সতর্কবার্তার পরেও দেশটি হামলা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে না যাওয়া মূলত অতি-আত্মবিশ্বাস থেকে। গৃহযুদ্ধ শেষে শান্তির সুবাতাস বইছে দেশে- এমন ভাবনাই হয়ত কাল হলো তাদের।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনটির ‘আমাক নিউজ এজেন্সি’ থেকে এই কথা জানানো হয়েছে। এদিকে, কেবল এ দুই সংগঠনই নয় শ্রীলঙ্কা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে স্থানীয় ইসলামপন্থী সংগঠন ‘ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত (এনটিজে)’ এসব আত্মঘাতী হামলার পেছনে কাজ করেছে। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও সরকারের মুখপাত্র রাজিতা সেনারত্ন স্থানীয় সংগঠনটিকে দায়ী করে জানান, সংগঠনটির আন্তর্জাতিক সংযোগের সম্ভাব্য সকল দিক এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কারা এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটাল এটা তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে এটা ঠিক এই হামলার শিকার ওই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। সারাবিশ্বে খ্রিস্টানরা যেভাবেই থাকুক না কেন শ্রীলঙ্কায় তারা সংখ্যালঘু, এবং এখন পর্যন্ত যাদের দায়ী বলে ভাবা হচ্ছে সেই মুসলিমরাও ওখানে সংখ্যালঘু; যদিও দেশে-দেশে অধিকাংশ সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম তাদের উগ্রবাদী অংশই চালিয়ে যাচ্ছে।
এই হামলা শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকেই আমূল বদলে দেবে বলে ধারণা করছি। পাশাপাশি দেশটি পর্যটক হারাবে, যে ক্ষতি তাদের অর্থনৈতিক। দেশটির ধর্মীয় সম্প্রীতির পালে যে হাওয়া লাগার কথা ছিল এই হামলার ঘটনায় সেটা মারাত্মকভাবে হোঁচট খেল। ধাক্কা কাটিয়ে শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াক- এটাই চাওয়া!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)