আমাদের বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন বা সংবিধান তাদের কতটা ক্ষমতা দিয়েছে এরকম প্রশ্নে স্বাধীনতার প্রশ্নটি বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং বিচারকরা আসলেই কতটা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন বা পারছেন, তা নিয়ে নানা সময়েই বিতর্ক হয়েছে।
সংবিধানের যে সংশোধনী নিয়ে এখন তুমুল আলোচনা হচ্ছে সেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়েও বলা হয়েছে, ‘The independence of the judiciary is the foundation stone of the constitution and as contemplated by article 22, it is one of the fundamental principles of State policy.’
আইনের শাসন প্রসঙ্গ এলেও আমাদের দেখতে হয় এর সাথে বিচার বিভাগের কী সম্পর্ক? আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এলে আমাদের অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নটির অবতারণা করতে হয় তা হলো, আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগের অবস্থান কোথায় বা সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগের এখতিয়ার কতটুকু? সেই সাথে এই আলোচনাটিও অনেক সময় তর্কের জন্ম দেয় যে, রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গের (আইন ও নির্বাহী) সাথে বিচার বিভাগের সম্পর্ক কেমন রয়েছে?
এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ‘জুডিসিয়ারি রিভিউ’ বা সাংবিধানিক পর্যালোচনা। আমাদের সংবিধানের কোথাও এই শব্দটির উল্লেখ না থাকলেও ৭, ২৬ এবং ১০২ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়। সংবিধানের ১০২ (২) অনুচ্ছেদ বলে সরকারি যেকোনো কাজের বা সংসদের পাশকৃত আইনের সাংবিধানিকতা বা Constitutionality পরীক্ষা বা পর্যালোচনা করতে পারেন আদালত। এটিই বিচারিক পর্যালোচনা বা জুডিশিয়ারি রিভিউ। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো মামলার সাথে সংবিধান-ব্যাখ্যার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত থাকলে উচ্চ আদালত তারও মীমাংসা করবেন। ২৬ অনুচ্ছেদের বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কোনো আইন যদি সংসদ প্রণয়ন করে তাও বাতিলের এখতিয়ার আদালতের রয়েছে।
বস্তুত সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো আইনের পরস্পর বিরোধী ধারা ও অস্পষ্টতার ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে সংবিধানের প্রকৃত অর্থ নিরূপণ করে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ১১তম প্রধান বিচারপতি Charles Evans Hughes (জন্ম ১১এপ্রিল, ১৮৬২ – মৃত্যু ২৭ আগস্ট, ১৯৪৮) এর একটি বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘We are under a Constitution, but the Constitution is what the judges say it is, and the judiciary is the safeguard of our property and our liberty and our property under the Constitution. অর্থাৎ আমরা সবাই সংবিধানের অধীন,কিন্তু সংবিধান হচ্ছে তাই, বিচারক যেটিকে সংবিধান বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ হচ্ছে নাগরিকের সম্পদের রক্ষাকর্তা এবং আমাদের স্বাধীনতা ও সম্পদ সংবিধানের অধীন। এ কথার অর্থই হলো, বিচার বিভাগ বা আরও স্পষ্ট করে বললে উচ্চ আদালত হচ্ছেন সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক। বাংলাদেশের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিনও এক সা
সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের ৯৪ থেকে ১১৭ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগ সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। এর মধ্যে ১১৪ থেকে ১১৭ পর্যন্ত অধস্তন আদালত সম্পর্কিত নির্দেশনা। এর আগে ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমহূত হতে বিচার বিভাগের পৃথকিকীরণের কথা বলা হয়েছে। আর ৯৪ এর (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকগণ বিচারকার্য পরিচালনায় স্বাধীন। কিন্তু তারপরও বিচারকরা আসলেই কতটা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব করতে পারেন বা পারছেন, তা নিয়ে নানা সময়েই বিতর্ক হয়েছে।
এই বিতর্কের মূলে রয়েছে ২২ অনুচ্ছেদের বাস্তবায়ন। মাজদার হোসেন মামলায় দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পরে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ আলাদা করা হলেও এটিকে এখনও কেবল ‘সেপারেশন’ বা পৃথককরণ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। কেননা ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তা এখনও যে পুরামাত্রায় বাস্তবায়িত হয়নি তার প্রমাণ বিচার বিভাগের জন্য এখনই একটি আলাদা সচিবালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বাহাত্তরের মূল সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলাবিধানের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকলেও পরে সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর অপর্ণ করা হয়। আর রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পণ মানে সেটির আখেরে দেখভাল করে আইন মন্ত্রণালয়। অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকারের সাথে উচ্চআদালতের টানাপোড়েন যে কোন পর্যাদয়ে পৌঁছাতে পারে, তা আমরা সম্প্রতি দেখেছি। অর্থাৎ অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলা ইস্যুতে বস্তুত একটা দ্বৈতশাসন বিদ্যমান।
এরকম তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ রায় দেন আপিল বিভাগ যেখানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে সংসদের ওপর অর্পণ করার কড়া সমালোচনার পাশাপাশি দেশের রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ,নেতৃত্ব ইত্যাদি নানান ইস্যু রায়ের পর্যবেক্ষণ এসেছে। পক্ষান্তরে সরকারের নীতি-নির্ধারক, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সংসদ সদস্যরা সংসদে এবং সংসদের বাইরে প্রধান বিচারপতির তীব্র সমালোচনা করেছেন যা কখনো বিষোদ্গারেও পরিণত হয়েছে। তাদের যুক্তি, এই রায়ে তিনি (প্রধান বিচারপতি) অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এমনকি তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছেন বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। ফলে সরকার এই রায়ের রিভিউ আবেদনের সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রুতই এই আবেদন করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।
রিভিউ আবেদনে সরকার বা রাষ্ট্রপক্ষ যদি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পর্যবেক্ষণগুলো বাতিল বা এক্সপঞ্জ চেয়ে যদি আবেদন করে এবং সর্বোচ্চ আদালত যদি সেই পর্যবেক্ষণ বাতিল করেন তাহলে দেশের সাংবিধানিক ও বিচারিক ইতিহাসে একটি নতুন ঘটনা ঘটবে। মনে রাখা দরকার, আপিল বিভাগের যে বিচারপতিরা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছিলেন, তাদেরই একজন জনাব আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা বর্তমানে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি। ধরে নেয়াই সঙ্গত যে, তার নেতৃত্বেই এই মামলার রিভিউয়ের রায় আসবে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি মি. সিনহার যে আর স্বপদে বহালের কোনো সম্ভাবনা নেই তা সরকারের তরফে একাধিকবার স্পষ্ট করা হয়েছে। আগামী ৩১ জানুয়ারি তার পদের মেয়াদ শেষ হবে।
দ্বিতীয়ত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সম্পর্কিত রায়ের রিভিউ যদি সরকারের পক্ষে যায় অর্থাৎ বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপরেই বহাল হয়, সেটিও একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে। চার দশক পরে সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে প্রতিস্থাপিত হবে (যদিও এটি ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু রিভিউয়ের পরে এর চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারিত হবে) এবং বিচার বিভাগের ওপর আইন তথা নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব বা মনস্তাত্ত্বিক চাপ যে আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ কম। ফলে রিভিউ রায়ের দিকেই এখন দেশের মানুষের নজর থাকবে।
তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে যখন এই বিতর্ক, তখন এই প্রশ্ন করাও খুব অন্যায় হবে না যে, সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আদালত যদি ষোড়শ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলে রায় দিয়ে এটি বাতিল করেন,তাহলে এ নিয়ে এত বিতর্ক কেন? যেকোনো রায়ের ব্যাপারেই সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের বিধান রয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু সাংবিধানিক এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক এবং রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দুটি অঙ্গের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, তা গণতন্ত্রের বিকাশে কতটা সহায়ক হচ্ছে কিংবা কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে হুট করে উপসংহারে আসা কঠিন।
( এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)