৪৭ জনের নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে আজ শুরু হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন আরেক যাত্রা। নতুন মন্ত্রিসভায় পূর্ণমন্ত্রীর পদ পেয়েছেন ২৪ জন, প্রতিমন্ত্রীর পদ পেয়েছেন ১৯ জন এবং উপ-মন্ত্রীর পদ পেয়েছেন ৩ জন।
শেখ হাসিনার নতুন এই মন্ত্রিসভায় যারা স্থান পেয়েছেন তাদের মধ্যে ২৭ জন একেবারেই নতুন। ২৭ জনের মধ্যে অনেকে কখনই ভাবেননি যে তিনি মন্ত্রী হবেন বা হতে পারেন। কিন্তু এক ফোনকলেই ভাগ্য দুয়ার তাদের খুলে গেছে। অনেকেই তাই নতুন এক শিহরণের মধ্যে রয়েছেন। একইভাবে যারা ভেবেছিলেন মন্ত্রিসভায় তারা অনিবার্য, থাকবেনই তাদের বড় অংশের ঠাঁই হয়নি মন্ত্রিসভাতে। সাধারণের চোখে অনেক অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের মন্ত্রী পরিষদে ডাক না পাওয়াটা বিস্ময়করও মনে হয়েছে।
গতকালই নতুন মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত হয়। আজ মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণ করেছেন। এ মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৩৪ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রীর। নতুন মন্ত্রিসভা এতোটা নতুন হবে তা কারোর কল্পনাতেই ছিল না। অনেকেরই ধারণা ছিল রাজনীতির মাঠে যারা পরীক্ষিত এবং ১৪ দলের বর্ষীয়ান নেতারা নিশ্চিত নতুন মন্ত্রিসভায় থাকবেন। কিন্তু কাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের ফোনকল শুরু হওয়ার পর বুঝা যায়, একেবারে নতুনদের নিয়েই তৈরি হচ্ছে নতুন মন্ত্রিসভা। পুরনোরা থাকছেন কয়েকজন মাত্র। অনেকেই এটিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন আরেক চমক বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন নতুন মন্ত্রিসভায় চমক থাকবে। কিন্তু চমকটা যে একেবারে চোখ ধাঁধানো তা বলাই বাহুল্য।
কেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতাদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলেন – এ বিষয়ে আপাতত কোনো ব্যাখা নেই। বিশেষ করে মোহাম্মদ নাসিম এমপি, তোফায়েল আহমদ এমপিসহ শরীক দলের রাশেদ খান মেনন এমপি, হাসানুল হক ইনু এমপিকেও বাদ দেওয়া হয়েছে এর কোনো ব্যাখা নেই। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় উল্লিখিতসহ আরও অনেকের পারফরম্যান্সই ছিল চমৎকার। তেমন কোনো অভিযোগও ছিল না। কিন্তু কেন তাদেরকে বাদ দেওয়া হলো সে ব্যাখা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ জানেন বলে মনে হয় না। অবশ্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘একজন মন্ত্রী থাকবেন, তার বদলে আরেকজন আসবেন এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে অসন্তোষের কিছু নেই। আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। এখানে একজনের জন্য আরেকজনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়।’
রাশেদ খান মেনন এমপি এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুর্দিনের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণিত। এ দুটি দল মন্ত্রিসভাতে স্থান পাওয়ার বহু আগেই থেকেই এক সাথে রাজপথের লড়াই-এ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনেকে স্নেহধন্যরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও এই দুই দলের নেতাকর্মীরা তাদের সমর্থন ও ভালোবাসা দুইই অটুট রেখেছে। সেই বিবেচনায় এবং কার্যকর জোট প্রমাণ করতে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি এবং জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তারকে নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হলে সেটা আরও ভাল হতো। নতুন মন্ত্রিসভা আরও আলোকিত হতো। জোটের শক্তি ও সংহতি আরও প্রকাশ পেতো। যদিও বলা হচ্ছে পরবর্তীতে তাদেরকে নেওয়া হতে পারে, কিন্তু শুরুতেই তাদেরকে নেওয়া হলে ক্ষতির চেয়ে জোটেরই বেশি লাভ হতো।
জীবনে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন বেশ কয়েকজন। দুই মেয়াদে জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা দীর্ঘসময় ধরে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোট ভাই এ কে আবদুল মোমেন সিলেট-১ আসন থেকে এবারই প্রথম এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জীবনে প্রথমবারের মতো এমপি পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বরিশাল-৫ আসন থেকে নির্বাচন করে জয়ী হয়ে আসা কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম প্রথমবারেই মন্ত্রী হলেন। উপ-মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এ কে এম এনামুল হক শামীমও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। আরেক উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও এবারই প্রথম চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
বিগত দিনে স্ট্যান্ডিং বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বা সভাপতি ছিলেন এরকম বেশ কয়েকজন এবার পূর্ণ এবং প্রতিমন্ত্রীর পদ লাভ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন-তাজুল ইসলাম এমপি, টিপু মুন্সী এমপি, ডা. দীপুমনি এমপি, হাছান মাহমুদ এমপি, ইমরান আহমেদ এমপি, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, মুন্নুজান সুফিয়ান এমপি। বিগত সংসদে তাজুল ইসলাম এমপি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। টিপু মুন্সী এমপি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। হাছান মাহমুদ ছিলেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ইমরান আহমেদ এমপি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। জাহিদ আহসান রাসেল এমপি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, মুন্নুজান সুফিয়ান ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ঐ একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়েছে।
মন্ত্রিসভায় যাদেরকে নতুন করে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে কেন নেওয়া হয়েছে তার উত্তর অনেকেরই জানা নেই। কামাল আহমেদ মজুমদারকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া অনেকেই ভাল চোখে দেখছেন না। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী হিসেবে ফের মন্নুজান সুফিয়ানকে অন্তর্ভুক্ত করা বোধগম্য নয়। পরিবেশ বন, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপ-মন্ত্রী হয়েছেন বেগম হাবিবুন নাহার। কিন্তু খুলনা অঞ্চলের আরও অনেক অভিজ্ঞ নেতা থাকলেও তাদের মন্ত্রী সভায় ঠাঁই হয়নি। মেহেরপুরের ফরহাদ হোসেন দোদুল এমপি, যশোরে স্বপন ভট্টাচার্য এমপির আকস্মিক মন্ত্রী হওয়াটাকে অনেকেই ‘মিরাকল’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে যত চমকের কথাই বলা হোক রাজনীতির মাঠের কিছু অভিজ্ঞ এমপির মন্ত্রীত্ব না পাওয়া হতাশাজনকই। তরুণদের মধ্যে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি, কাজী নাবিল আহমেদ এমপি, মাগুরা থেকে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হওয়া এমপি অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখরকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া হলে সেটা বোধ হয় আরও ভাল হতো।
নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে যতই চমকের কথাই বলা হোক-সেটা কোনো কথা নয়। নতুনরা পারফরম্যান্সে কতোটা চমক দেখাতে পারবে সেটাই বড় বিষয়। জনগণ সেই চমকটাই দেখতে চায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)