বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছ থেকে রাজনৈতিক বক্তব্যের আশা যেন ক্রমশ দূরাশাই হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও গঠনমূলক বক্তব্য বাদ দিয়ে সবাই মেতে উঠছে যেন তেলবাজী আর ছেলেখেলায়। ২৪ নভেম্বর ২০১৬ এর দৈনিক যুগান্তরে ‘ছোট বোন নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও আমি তোমার নির্বাচন করে দিচ্ছি’ শিরোনামের সংবাদটি তার নগ্ন দৃষ্টান্ত। মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ, ভোট দেবে জনগণ আর নির্বাচন করে দেবে হাসিনা লীগের নেতা
সাংসদ শামীম ওসমান সেলিনা হায়াত আইভীর মাথায় হাত দিয়ে তার নির্বাচন করে দেবে বললেন। এর আগে বললেন সেলিনা হায়াত আইভী বিএনপি জামাত সংশ্লিষ্ট সুশীল। শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সামনে বললেন, “আমি আওয়ামী লীগ করি না, হাসিনা লীগ করি।”
শামীম ওসমান দলীয় সভানেত্রীকে বললেন, আমাকে একটি চড় দেন। নেত্রী বললেন, তোমাকে চড় দিতে যাব কেন? শামীম ওসমান নেত্রীর হাত নিজের গালে লাগিয়ে নিজেকে নিজেই কৃত্রিম চড় মেরে দিলেন।এক সময় শেখ হাসিনা কপালের চুল সরিয়ে বললেন, এই দেখো আমার কপালে একটি দাগ আছে, এই দাগটা যার জন্য আমি তাকেও মন্ত্রীসভায় ঠাঁই দিয়েছি।
সেলিনা হায়াত আইভীকে কেনই বা নারায়ণগঞ্জের মেয়র পদে মনোনয়ন দিলেন আর কেনই বা শামীম ওসমানের কাছে এত অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন? দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে তার পক্ষেই কাজ করো – কঠোরভাবে এমনটি না বলে মনোনয়ন চূড়ান্তের পরে কেন গ্রুপিং মিটমাটের সভা? কেন নির্বাচন করবেন না বলে আইভীর চলে যেতে চাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি? শামীম ওসমান প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ করেন না, হাসিনা লীগ করেন বলা সত্ত্বেও কেন প্রতিবাদ হলো না? যে ব্যক্তি শেখ হাসিনার কপালের দাগের কারণ কেনই বা তাকে মন্ত্রিত্ব দিতে বাধ্য হলেন? দেশের সুস্থধারার রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রক্ষায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আবশ্যক।
দেশের প্রধানমন্ত্রী, দল ও জোটের প্রধানের যদি শত্রুতাকারী, অনাদর্শিক ব্যক্তিদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয় তাহলে রাজনীতির গতি যে বিপথগামী তা সহজেই অনুমানযোগ্য। বহিঃশত্রুর শত্রুতার চেয়ে ঘরের শত্রুর শত্রুতা ভয়াবহ হয়। চাটুকার ও তেলবাজরা যে কখনো আদর্শিক মিত্র হতে পারে না এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। তেলবাজদের প্রশ্রয় দেয়াও প্রশ্রয় দানকারীদের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়।
আওয়ামী লীগের দলীয় গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের কোথাও নিশ্চয়ই হাসিনা লীগের কথা বলা নেই। “আমি আওয়ামী লীগ করি না, হাসিনা লীগ করি” – এ কথা বলার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে ব্যক্তি হাসিনাকে খুশি করার জন্য তেলবাজী। নেত্রী কি এই তেলবাজীতে খুশি হলেন? নইলে কেন তার প্রতিবাদ করলেন না? মৃদু অথবা কঠোর ধমকের সুরে বললেন না, তুমি আওয়ামী লীগের সাংসদ, হাসিনা লীগের নও।
“আমি আওয়ামী লীগ করি না” বলার পরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শামীম ওসমানের প্রশংসা করলেন। তাকে ধন্যবাদ জানালেন আইভীর প্রার্থিতা মেনে নেয়ার জন্য। হয়তো এই প্রার্থিতা না-ও মেনে নিতে পারতেন তিনি! অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হচ্ছে যে, শামীম ওসমান দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে মেনে নেয়ায় যেন দল ধন্য হলো।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় অনেকেই কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে, কেউ বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক হিসাবে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। শামীম ওসমানদের বেলায় এমন পদক্ষেপ গ্রহণে যে দলের ক্ষমতা নেই সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল। নইলে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্তের পরে কেন তাকে নরম সুরে কথা বলা ও তার গরম সুরের এবং অসাংগঠনিক বক্তব্যকে প্রশ্রয় দেয়া?
সন্ত্রাস ও গডফাদারদের বিরোধিতা করেই সেলিনা হায়াত আইভী বিগত নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর এবার সন্ত্রাসের গডফাদার স্বয়ং বলছে আইভীর নির্বাচন করে দেবে। এই সন্ত্রাসবিরোধী ও সন্ত্রাসকারীর মিলনমেলার ফল কী হয় তা সময় বলে দেবে। শামীম ওসমানদের প্রতি নেত্রী ও দল কেন এত অসহায়? যখন শামীম ওসমান নেত্রীর হাত নিজের গালে লাগিয়ে কৃত্রিম চড় খাওয়ার কপটতা করে তখন জাতি স্তম্ভিত হয়। কেন নেত্রী তখন তাকে ধমক দিতে পারলেন না?
মনোনয়ন বিরোধের নিষ্পত্তি করতে না পারলে উন্মুক্ত প্রতীকে নির্বাচন করার নজিরটাও তো বেশিদিন আগের নয়। বিগত ইউপি নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের এলাকায় দু’টি ইউনিয়নে কাউকে নৌকা মার্কা দেয়া সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক এমপির সংসদীয় এলাকা অষ্টগ্রামের আদমপুর ও খয়েরপুর-আব্দুল্লাহ পুর ইউনিয়নে এই ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে দল প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিদ্রোহী সমর্থক নেতাদের বহিষ্কার করা হবে এমন ঘোষণা দিতে সাহস পায়নি।
সেখানে তৃণমূল ভোটে হেরে গিয়েছিল রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক এমপির সমর্থিত প্রার্থী। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ছেলে বিদ্রোহী সমর্থক হয়ে গেলে কী করে তাকে বহিষ্কার করবে! শামীম ওসমানের বেলাতেও হয়তো এই ভাবনাই কাজ করেছে।
এত ভয়ই যদি, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনও অষ্টগ্রামের দুই ইউনিয়নের মতো উন্মুক্ত মার্কাতে দিয়ে দিলেই হতো। জনতার ভোটে যে পাশ করে আসতে পারে আসত। সারা দেশের মানুষের কাছে যে মানুষটার পরিচিতি সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে, খোদ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের তাকে এমন প্রশ্রয়দান অনেককে আহত করেছে। এটি বিএনপি জামাতের মেয়র প্রার্থীর ভোট বাড়ানোরও সহায়ক হবে।
শামীম ওসমান আইভীর পক্ষে ভোট চাইলে নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসবিরোধী সেন্টিমেন্ট আইভীর বিপক্ষে যেতে বাধ্য। আর আইভীর বিপক্ষে গেলে কার পক্ষে যাবে সেটা পরিষ্কার। ইতোমধ্যেই আইভীকেও বলতে শোনা গেছে, শামীম ওসমান পক্ষে থাকলে ভালো, না থাকলে আরও ভালো। আইভীর এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ প্রচার হচ্ছে। বিতর্কও জমেছে বেশ। জনমনে এই প্রশ্নটা জোরেসোরেই জাগছে যে, আইভীর নির্বাচনী মঞ্চে শামীম ওসমান থাকলে বিগত মেয়র নির্বাচনে সন্ত্রাসবিরোধী ইস্যুতে যারা আইভীর পক্ষে ছিল তারা কি এবারও থাকবে?
সেই রফিউর রাব্বী নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের নেতা।যার ছেলে হত্যার মদদে সন্দেহের তীর শামীম ওসমানের দিকে। সেই রফিউর রাব্বীসহ নারায়ণগঞ্জের সচেতন মহল আইভী-শামীমের এক মঞ্চে উপস্থিতিকে কিভাবে নেবে? অতীতে আইভী শামীম সম্পর্কে যা বলেছেন তা কি মিথ্যে ছিল? নাগরিক সমাজের নেতারা যা বলেছিল তা কি মিথ্যে ছিল? এক কথায় নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা পড়বে এক চরম মানসিক দ্বন্দ্বে।এই দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত ফল দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন পর্যন্ত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)