বিভিন্ন ঘরানার নানান ধরনের দিবস উদযাপনকে আমরা ঠেসে ঠুসে সোশ্যাল মিডিয়ার জগতটাতে এঁটে নিয়েছি। কিন্তু, মজার বিষয় কি জানেন? খোদ সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ে যে একটা দিবস আছে, তা জানি আমরা ক’জন?
এরই মধ্যে গুগলে সার্চ দেয়ার জন্য আঙ্গুল বাড়িয়েছেন নিশ্চয়ই? থাক না। আজ অর্থাৎ ৩০ জুন বিশ্ব সোশ্যাল মিডিয়া দিবস। কিন্তু কে চালু করলো? কবেই বা চালু হলো তা? মিডিয়া কোম্পানি ম্যাশএইবল (Mashable) এর পুরোটা কৃতিত্ব এ দিবসের পেছনে।
আজ থেকে নয় বছর আগে চালু হওয়া সোশ্যাল মিডিয়া দিবস পাশ্চাত্যে জায়গা করে নিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। যা হোক, সোশ্যাল মিডিয়া দিবস তো জানালাম। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াকে জানেন তো ঠিকভাবে?
বেশ কিছু সম্মিলিত কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি… ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটা, হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট….কানে তালা লাগবার জোগাড়। এবার একটু শান্তভাবে জেনে নেই হালের ক্রেজ ‘সোশ্যাল মিডিয়ার’ ইতিবৃত্ত।
সোশ্যাল মিডিয়া শুনলেই চোখে ভাসে স্মার্টফোন আর ল্যাপটপের স্ক্রিন। ওখান থেকে বের হতে হবে এবার। বাংলা করলেই সহজ হয়ে যাবে ব্যাপরটা। সোশ্যাল মিডিয়া=সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। মানুষের সামাজিক হওয়া, যোগাযোগ করা কিংবা মাধ্যম ব্যবহার করার ইতিহাসটা বহু পুরোনো, একেবারে শ্যাওলা ধরা, বলতে পারেন কম্পিউটার, ইন্টারনেট আবিষ্কারের হাজার হাজার বছর আগের।
শুরুতে মানুষের বন্য থেকে সামাজিক হতে প্রয়োজন ছিল যোগাযোগ। আর মাধ্যমটা ছিল মূলত ইশারা বা ইঙ্গিত। ইংরেজিতে যাকে বলে Gesture। এই শব্দটা নিয়েও দ্বিধা কাটাই। অনেকে ওনাকে আদর করে ‘গেশ্চার’ বা ‘গেস্টিউর’ বলে ফেলে। শব্দটা আসলে ‘জেশ্চার’। সে প্রসঙ্গ থাক। মূল আলাপে ফিরি। ইঙ্গিত থেকে ভাষা, লিখিত বর্ণ সবই হলো ওই সামাজিক মানুষের যোগাযোগের জন্য।
এবার উৎসাহী মানুষ দূর-দূরান্ত ঘুরতে লাগলো। প্রিয়জন থেকে দূরে গড়তে লাগলো বসতি। এবার সামাজিক যোগাযোগের তাহলে কি হবে? যোগাযোগের এই তাড়না থেকে সৃষ্টি হলো নতুন মাধ্যম। ডাক যোগাযোগ। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ এ মোটামোটিভাবে এ ধারণার প্রচলন। এরপর টেলিগ্রাম, টেলিফোন, রেডিও…
রেডিও? শুনে বেঁকে বসলেন কেন? ওটাও তো ওই সামাজিক মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। তাহলে কালের বিবর্তনে সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে গেলো দূরে থাকা মানুষের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।
কোথায় যেন ছিলাম? ওঃ হ্যাঁ। রেডিও। এরপর রেডিও থেকে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ওয়েব, মোবাইল, এসএমএস… ডাক ব্যবস্থা থেকে ইমেইল। এ বিবর্তনের ব্যবধানটা জানেন? খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ! তার মানে ২৫ শ ১৬ বছর মাত্র!
এরপর আসি টেলিফোন থেকে মোবাইল। ১৮৯০ থেকে ১৯৮৩। প্রায় ১০০ বছর। আর মোবাইল ফোন থেকে স্মার্টফোনের বিবর্তন? চোখের পলকে বললেও কম হয়ে যাবে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২। মাত্র ৯ বছর। এখান থেকেই ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ সব খোলস ছেড়ে টুক করে ঢুকে পড়ে সামাজিক মানুষের হাতের মুঠোয়।
১৯৯৭ সালে আধুনিক যুগের প্রথম ‘ইন্টারনেটভিত্তিক’ সোশ্যাল মিডিয়া ‘সিক্স ডিগ্রি’ যাত্রা শুরু করে। আজকের সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মতোই সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে যোগাযোগ করা যেত। ২০০১ এ শেষ হয় সিক্স ডিগ্রি অধ্যায়।
এরপর শুরু হয় জোয়ার! সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের জোয়ার। ফেসবুক, টুইটার, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, ভাইবার, স্ন্যাপচ্যাট, ডুয়ো, টিন্ডার, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডইন, পিনটারেস্ট, ডিগ, লাইন, হোয়াটসঅ্যাপ, হ্যাঙ্গআউট, গুগল প্লাস, হাইফাইভ, মিগ থার্টি থ্রি, মিউজিকালি, স্কাইপ, এমএসএন, ইউটিউ…. ধাক্কাধাক্কি করবেন না প্লিজ। এ তালিকাটি জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে তো নয়!
পূর্বের দূরের যোগাযোগ সংজ্ঞা বদলালো। এখন আর পিতার কাছে টাকা চেয়ে পুত্রের পত্র বা নীল খামের প্রেমপত্রে সীমাবদ্ধ নেই সামাজিক যোগাযোগ। বরং পিতার বিকাশে পাঠানো টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করে সারা দুনিয়ার সাথে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ করছে পুত্র। সে তালিকায় পিতা আছে কি না তা খুঁজতে হবে। আর অন্যদিকে নীল খামের চিঠি বদলে গেছে নীল তিনটা আইকনে…ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার।
ফেসবুক আর ম্যাসেঞ্জারে চলছে ধুন্ধুমার যোগাযোগ। আর আগের দিনের দেয়ালে টানানো কিংবা বইয়ের মধ্যে লুকোনো নায়ক-নায়িকার পোস্টারের জায়গা করে নিয়েছে টুইটার। ভার্চুয়ালি টাচে থাকা গেলে কে অত কষ্ট করে পোস্টার কিনবে!!!!
শুধু কি যোগাযোগ? সামাজিক মানুষের সকল অসামাজিক কার্যকলাপও সামাজিক যোগাযোগের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে অবলীলায়। কাইজ্যা-ফ্যাসাদ- clash, পঁচানো-troll or roast, খোঁচা মারা-poke, আর গালি গালাজ তো kidding এর সমার্থক। আর রাত বাড়লেই লাইভে যা চলে তা এখানে না লিখি।
সোশ্যাল মিডিয়া কি তাহলে নেতিবাচক কিছু? কে বললো? নেতিবাচক কথা বলে শুরু যখন করলাম তখন এ ধারণা ভাঙ্গার দায়িত্বটাও নিচ্ছি। এই মুহূর্তে জরুরি রক্ত দরকার। কি করবেন? সহজ তো? বাংলাদেশেরই তরুণ প্রাণ শাহরিয়ার জিসান ফেসবুকে চালু করেছেন ব্লাডম্যান নামের ব্লাড ডোনেশন প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুক ডোনেশনের আইডিয়াটা নিয়েছে এখান থেকেই।
আর নিজের জীবনের উদাহরণ না দিয়ে থাকি কিভাবে। গত বছরই ভারপ্রাপ্ত ইউএনও থাকার সময় এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে দুই হাজারের বেশি মানুষকে নিয়ে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধ এলাকার দশ কিলোমিটারের ছয়টি খালের কচুরিপানা অপসারণ করেছি একদিনে, আবার আরেক স্ট্যাটাসের আহবানে ৪ লাখ তালবীজ রোপন করেছি একদিনে। এভাবেও তো সঙ্গী হয় সোশ্যাল মিডিয়া।
বর্তমানে কেনাকাটার জগতে বিশাল অংশ জুড়ে আছে ফেসবুক পেজ, গ্রুপ আর লাইভ। লেখালেখির অভ্যাস গড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপ। জানার জানালাটা হয়েছে বড় আর খোলামেলা। জ্ঞানের সুবাতাস ঢুকছে অবিরত।
উদযাপনের আরেকটা দিবস বাড়ুক, তা ঠিক চাই না। তবে, সোশ্যাল মিডিয়ার আদিম সেই ধারণাটা যেন টিকে থাকে চিরকাল। সমাজবদ্ধ মানুষের শালীন সামাজিক যোগাযোগের প্রযুক্তিগত মাধ্যমই হোক ‘সোশ্যাল মিডিয়ার’ যথার্থ ট্রান্সলেশন।
ছোট্ট স্ক্রিনটা থেকে একটু চোখ সরাবেন? দেখুন গভীর বনে বসে আদিম কোনো মানুষ একলা বসে কাঁদছে আর বলছে, ‘একাকিত্ব ভাঙ্গার আশায় সমাজ গড়েছিলাম। হাজার বছরের চলার পথে যন্ত্র দিয়ে আবার একা করে দিলে তো আমায়! শুনতে কি পাও আধুনিক হোমো সেপিয়েন্স???’
আধুনিক মানুষ তখন কানে হেডফোন গুঁজে ইউটিউবে মেকাপ কিংবা ফোনের রিভিউ দেখায় ব্যস্ত!
শুভ সোশ্যাল মিডিয়া দিবস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)