স্বাধীনতার ৫০ বছর পা দেবার বছরে আবার এসেছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দ্বারপ্রান্তে পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য এই বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটিত হয়েছিল, যাতে করে স্বাধীন হলেও বাঙালি কখনও যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এধরণের ঘৃণিত কাজ করার নজির বিশ্বে খুবই কম। ভিয়েতনাম, বসনিয়াতেও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। তবে তার এত ব্যাপকতা ছিল না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পরপরই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এই দিনকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং একটি তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু তার ঐ সিদ্ধান্ত পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বেসরকারিভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনও আজও প্রকাশিত হয়নি। ওই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। ওই তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হওয়ার পর সেই কমিটির তদন্ত কমিটির কাজের আর অগ্রগতি হয়নি। ধারণা করা হয়, তদন্তের কাজের জন্য অপরাধীদের রোষের শিকার হয়ে তিনি নিহত হন।
বুদ্ধিজীবী দিবস এলেই নানা কর্মসূচি পালন হয়, বাণী দেন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকে এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের দাবির কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়।
১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। দীর্ঘদিন বিচার চলার পরে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়া দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। রায়ে বলা হয়, আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন সেই হত্যাকাণ্ডের ‘চিফ এক্সিকিউটর’। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে ওই হত্যা পরিকল্পনা ও একটি তালিকাও পাওয়া যায়।
দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনই পলাতক বহুবছর ধরে। পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছে যুক্তরাষ্ট্রে, আর মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চৌধুরী মঈনুদ্দীনের বিষয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। তাকে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি ব্রিটিশ সরকার।
আমরা মনে করি, যুদ্ধাপরাধ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বর্তমানে আদালতের রায়ে মিমাংসিত ও চলমান যুদ্ধাপরাধের মামলাতে সামষ্টিক বিবেচনা নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তেমন আলোচিত হয়নি। শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য পৃথক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, পৃথক মামলা হওয়া প্রয়োজন। যেখানে শুধুমাত্র এই বিষয়ের উপরে আলোকপাত করা হবে। সেই সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন, তাহলে হয়তো জাতি শহীদরে আত্মত্যাগের কিছুটা হলেও মূল্যায়ন করতে পারবে।