জেনারেল শফিউল্লাহ ‘রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনী প্রধান হলেও ওই সিদ্ধান্ত দেওয়া রাষ্ট্রপতির চরম দুঃসময়ে প্রথম সুযোগেই তিনি পাশে দাঁড়াতে পারেননি। যে কারণে তাকেও সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে যেতে হয়, রাষ্ট্রদূত হয়ে চলে যেতে হয় বিদেশে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সেসময়ের সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহর সাক্ষ্যে তার সেই ব্যর্থতা এবং অসহায়ত্বের কথা ফুটে উঠেছে। ওই সময়ের গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথাও জানা গেছে তার বক্তব্যে। বোঝা গেছে, খুনিরা আগের সন্ধ্যা থেকে সাজ সাজ রবে হত্যা প্রস্তুতি নিলেও গোয়েন্দারা বিষয়টি জানতে পেরেছেন আর্টিলারি এবং ল্যান্সার সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার পর।
শফিউল্লাহ জানান: ১৫ আগস্ট তার বেটম্যান দরোজা ধাক্কা দিলে বের হয়ে দেখেন ডিএমআই (ডিরেক্টর, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন এসেছেন। সালাহউদ্দিন তাকে জিজ্ঞেশ করেন, স্যার, আপনি কি আরমার এবং আর্টিলারিকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? জবাবে শফিউল্লাহ ‘না’ বললে সালাহউদ্দিন জানান, তারা তো রেডিও সেন্টার, গণভবন এবং ৩২ নম্বর রোডের দিকে যাচ্ছে।
ডিএমআই’র কথা শুনে সেনাপ্রধান শংকিত বোধ করেন এবং জিজ্ঞেস করেন, ডাজ সাফায়েত (৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার) নো অ্যাবাউট ইট? কর্নেল সালাহউদ্দিন এ বিষয়ে কিছু জানেন না এবং ‘প্রথমে আপনার কাছেই এসেছি’ জানালে শফিউল্লাহ তাকে বলেন, সাফায়েতের কাছে যাও এবং তিনটা পদাতিক ব্যাটালিয়নকে দিয়ে প্রতিহত করার জন্য আমার নির্দেশ জানাও, আমিও তাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিচ্ছি।
শফিউল্লাহর দাবি, তিনি পরে টেলিফোনেও সাফায়াতকে একইরকম নির্দেশ দেন। সাফায়েতও তা স্বীকার করেছেন, কিন্তু আসল কাজ কিছু হয়নি।
শফিউল্লাহ জানান, সেসময় সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে ফোনে না পেলেও একসময় বঙ্গবন্ধুই তাকে ফোনে পেয়ে বলেন, শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।
জবাবে শফিউল্লাহ প্রেসিডেন্টকে কিছু একটা করছি বললেও রাষ্ট্রপতিকে তাৎক্ষণিকভাবে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান। আর্মি চিফ বলেছিলেন: আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট অব দ্যা হাউস?
এর ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার বাসায় আসেন। তিনি তখন খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে সাফায়েতকে সহায়তার নির্দেশ দেন। কারণ তার ভাষায়, তখনও পর্যন্ত তার দেওয়া নির্দেশে কোনো তৎপরতা দেখতে পাচ্ছিলেন না। জেনারেল শফিউল্লাহ জানান, এক পর্যায়ে ডেপুটি চিফ জিয়া বলেন, ডু নট সেন্ড হিম। হি ইজ গোয়িং টু স্পয়েল ইট।
সেনাপ্রধানের এভাবে কিছু করতে ব্যর্থতার মধ্যে অনুমান সকাল ৭টার দিকে রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা শুনতে পান। এ পর্যায়ে ডেপুটি চিফ জিয়া বলেন, খালেদ মোশাররফকে আর বাইরে যেতে দিও না। তাকে বলো ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করতে, কারণ ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন দিস প্রিটেক্সট।
শফিউল্লাহ পরে ৪৬ ব্রিগেডে যেতে চাইলে, তার ভাষ্যমতে, মেজর ডালিমও তার সৈন্য-সামন্ত এবং অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত গাড়ি নিয়ে তার পেছনে পেছনে যায়। মেজর রশিদ এবং মেজর হাফিজ তাকে রেডিও সেন্টারে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। সেনাপ্রধানের দাবি: ওই জায়গার পরিবেশ দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান এবং তাদের চাপের মুখে বলেন যে, আমি একা যাবো না, এয়ার এবং নেভাল চিফের সঙ্গে কথা বলি।
সেনাপ্রধানের প্রতিরোধ চেষ্টা এভাবে সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তার ভাষায় ‘কোনো কাউন্টার অ্যাকশনে রক্তপাত ও সিভিল ওয়ার হতে পারে,’ এই ধরণের পরিস্থিতি ধারণা করে মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিমের অস্ত্রের মুখে তিনি রেডিও সেন্টারে যেতে বাধ্য হন।
এর অনেক আগেই রেডিও সেন্টারের দখল নিয়েছিলো ঘাতকদল। বাংলাদেশ বেতারের স্টেশন প্রকৌশলী এবং মামলার ৩৭ নম্বর সাক্ষী মোঃ রিয়াজুল হক বলেন, সেদিন সকাল ৬টা-২টা ডিউটি করার জন্য ৬টা/সোয়া ৬টার দিকে শাহবাগে বেতার ভবনে গিয়ে তা সেনা নিয়ন্ত্রণে দেখতে পান।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৩৮ নম্বর সাক্ষী, বেতার প্রকৌশলী প্রণব চন্দ্র রায় জানিয়েছেন, সকাল পৌণে ৬টার দিকে কিছু সেনা সদস্য পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বেতার ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ শেষে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তারা রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখে, মেজর ডালিম এরইমধ্যে রেডিওর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যার কথা প্রচার করছে।
শাহরিয়ার জানিয়েছে, তখন রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা তিনটি ট্রাকে করে রেডিও স্টেশনে আসলে সে তাদের ‘ডিস-আর্ম’ করে প্রথমে রেডিও স্টেশনে বসিয়ে রাখে, পরে রক্ষী বাহিনী হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ফেরত পাঠায়।
কিছু পরে খন্দকার মুশতাক রেডিও স্টেশনে আসে। সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইম মার্শাল একে খন্দকার, বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান নুরুল ইসলাম এবং রক্ষী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেজর হাসান সেখানে এসে রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে খন্দকার মুশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।
রেডিও স্টেশনে সেসময় জেনারেল জিয়া ছাড়াও কর্নেল (অব.) তাহের এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল (অব.) আতাউল গণি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন ৩৭ নম্বর সাক্ষী রিয়াজুল হক।
পরে বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানেও তারা সকলেই যোগ দেন।
শফিউল্লাহ জানান: ১৫ আগস্ট শপথ অনুষ্ঠান শেষে তিনি বঙ্গভবন থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তাকে বলেন, কনফারেন্স হবে, এখন যাবেন না। সেই না যাওয়া ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত গড়ায়। এক কাপড়ে এই ক’দিন বঙ্গভবনে অবস্থানে বাধ্য থাকার সময় তিনি ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জিয়া, শাহ মোয়াজ্জেম এবং কে এম ওবায়দুর রহমানকে বঙ্গভবনে আসা-যাওয়া করতে দেখেন। সবসময় তাদের সঙ্গে থাকতো ঠাকুর।
ওইসময়ের বর্ণনা দিয়ে শফিউল্লাহ জানান, খন্দকার মুশতাক প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রথমেই গাজী গোলাম মোস্তফাকে রেডক্রস চিফের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। দ্বিতীয় যে কাজটি খন্দকার মুশতাক করেন, সেটি হচ্ছে মাহবুব আলম চাষীকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগদান।
পরের সময়গুলোতে কি হয়েছে জানাতে গিয়ে শফিউল্লাহ বলেন, ১৮ আগস্ট বঙ্গভবন থেকে ফিরে রাতে একটি কনফারেন্স ডাকেন। এতে এয়ার ও নেভি চিফ, বিডিআর প্রধান, আইজি নুরুল ইসলাম, ডিজিএফআই’র ব্রিগেডিয়ার রউফ, ডিএমএ কর্নেল নূর উদ্দিন এবং ডিএসটি কর্নেল মালেকসহ সিনিয়র অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। সেনাপ্রধান হিসেবে শফিউল্লাহকে বলা হয়, এইসব উচ্ছৃঙ্খল অফিসারের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
পরদিন ফরমেশন কমান্ডারদের যে বৈঠক ডাকা হয় তাতে খন্দকার মুশতাকের নির্দেশে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুকও যোগ দেয়। কনফারেন্সের উদ্দেশ্য ছিলো শৃঙ্খলাভঙ্গকারী অফিসারদের সেনানিবাসে ফেরত আনা। ফেরত আনার উদ্দেশ্যে কৌশলগতভাবে শফিউল্লাহ বলেন, ইন্ডিয়া মাইট অ্যাটাক বাংলাদেশ। আমাদের এটা প্রতিহত করতে হবে। তাই রিগ্রুপিং এর দরকার আছে।
এক পর্যায়ে মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুককে লক্ষ্য করে সাফায়েত জামিল বলেন, দে মাস্ট বি পুট টু কোর্ট মার্শাল। শফিউল্লাহ বলেন, এতে তাদের মুখ মলিন হয়ে যায়।
ফারুক-রশিদের মুখ মলিন হয়ে গেলেও ব্যবস্থা কিন্তু কেউ নিতে পারেননি। বরং শফিউল্লাহর নিজের ভাষায়, মনে হলো কনফারেন্স ডাকার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাই কনফারেন্সের সমাপ্তি ঘোষণা করে শফিউল্লাহ চলে আসেন, প্রতিক্রিয়া দেখতে থাকেন।
অক্ষম সেনাপ্রধান আবার ২২ আগস্ট বঙ্গভবনে সেই খন্দকার মুশতাকের কাছে যান যাকে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানেন না বলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। সেদিনও তিনি ট্রুপস ফিরিয়ে এনে রিগ্রুপিং এর কথা জানান। জবাবে খন্দকার মুশতাক বলেন, ওয়েট এন্ড সি। ‘এভাবে সেদিনও বঙ্গভবন থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসি,’ বলে জানান ব্যর্থ সেনাপ্রধান।
শফিউল্লাহ জানান: ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে নিউজ বুলেটিনে জেনারেল ওসমানীকে ডিফেন্স অ্যাডভাইজার করার ঘোষণা জানতে পারেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রেসিডেন্টের ফোন আসে। মুশতাক তাকে বলে, তুমি শুনেছো? শুনেছি জানালে মুশতাক বলে, ডিড ইউ লাইক ইট? জবাবে শফিউল্লাহ বলেন, ভালো হয়েছে। মুশতাক তাকে পরে বিকেল সাড়ে ৫টায় বঙ্গভবনে যেতে বলেন।
সময়মতো বঙ্গভবনে গিয়ে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল খলিলকে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে যেতে দেখেন তিনি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার আগে তাকে ওসমানীর সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়।
ওসমানী শফিউল্লাহর অনেক প্রশংসা করে বলেন, তুমি দেশের জন্য অনেক কিছু করেছো, এখন তোমার সার্ভিস বিদেশে দরকার।
শফিউল্লাহ তখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওসমানীসহ খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মুশতাকও শফিউল্লাহর অনেক প্রশংসা করে বলেন, তোমার সার্ভিস এখন দেশের বাইরে দরকার।
তার জায়গায় কে আসছেন জানতে চাইলে মুশতাক জিয়ার নাম বলে। শফিউল্লাহ তখন বলেন, ডোন্ট থিংক এট দিস স্টেজ জিয়া উইল বি মিসআন্ডারস্টুড? জবাবে মুশতাক বলে, দিস উইল বি টেকেন কেয়ার অফ।
শফিউল্লাহ দেশের বাইরে যেতে রাজি নন জানালে মুশতাক বলেন, ডোন্ট থিংক অব স্টেয়িং ইন দ্যা কান্ট্রি। শফিউল্লাহ তখন আর উচ্চবাচ্য না করে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসেন বলে জানান। দেখেন জেনারেল জিয়া এরইমধ্যে চিফ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করছেন।
জেনারেল শফিউল্লাহ সেদিন সেনাপ্রধানের পদ হারানোর আগে জিয়াসহ যাকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেন, সেই জেনারেল খলিল ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জানান: ২০ আগস্ট খন্দকার মুশতাক মার্শাল ল জারি করে। ২৪ আগস্ট জানতে পারেন জেনারেল ওসমানীকে ডিফেন্স অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বঙ্গভবন থেকে তাকে বিকেল ৪টায় বঙ্গভবনে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে দেখেন, জেনারেল জিয়াও উপস্থিত।
মেজর রশিদ, মেজর ডালিম এবং আরো একজনের উপস্থিতিতে জেনারেল ওসমানী জেনারেল খলিলকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ এবং জেনারেল জিয়াকে চিফ অব আর্মি হিসেবে ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে ওইসময় ভারতে অবস্থান করা ব্রিগেডিয়ার এরশাদকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ এবং জেনারেল দস্তগীরকে বিডিআর চিফ করা হয়। অপরদিকে, শফিউল্লাহকে বদলি করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
এভাবে মুশতাকের ডিফেন্স অ্যাডভাইজার হওয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানো শুরু হয়।
আর ১৮ আগস্ট বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করা মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি এ কে খন্দকারের জায়গায় তখন জার্মানিতে অবস্থান করা গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াবকে বিমানবাহিনী প্রধান করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে সব ধরণের বেনিফিটসহ অবসরে যাওয়া তোয়াব ৭১ থেকে জার্মানিতেই অবস্থান করছিলেন। তাকে সেখান থেকে দেশে নিয়ে আসে মুশতাকের দুই বিশেষ সহকারির একজন মেজর রশিদ। অন্য বিশেষ সহকারি ছিলো মেজর ফারুক।
তোয়াব দায়িত্ব নেওয়ার পর খন্দকারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয়। পরে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন বিচারপতি সায়েম তাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দিলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে তিনি তাতে রাজি হন বলে জানান। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করা হয়।
তখন ওসমানীর প্রভাব কমে আসলেও আগের অনেক ঘটনার নেপথ্যেই ছিলেন ৭৫’র ১৫ আগস্ট সকালে রেডিও স্টেশন থেকে মুশতাকের পাশে পাশে থাকা জেনারেল ওসমানী। ২৪ আগস্ট তিনি প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হলেও আরো প্রায় ১০ দিন আগে থেকেই তিনি সশস্ত্রবাহিনীকে খুনিদের পক্ষে পরিচালনা করেন।
তবে তার নিয়ন্ত্রণও খন্দকার মুশতাকের মতোই খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
১৫ আগস্ট এবং জেলহত্যার খুনিরা দেশ ছাড়ার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করে ততোদিনে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হওয়া জেনারেল খলিল বলেন, ৩ নভেম্বর খুব সকালে ডিজিএফআই’র এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম তাকে ফোন করে জানান, ক্যান্টনমেন্টে ট্রুপস মুভমেন্ট হচ্ছে এবং বেশ গোলমাল। তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তিনি ওসমানীকে টেলিফোন করেন। কিন্তু তাকে ফোনে পান না। পরে যখন ওসমানীকে পান, তখন আরো একবার তিনি (ওসমানী) খন্দকার মুশতাকের পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরেছেন।
সকাল ১০টার দিকে খলিল বঙ্গভবনে গেলে সেখানে আইজিপি নুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানান, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি মাহবুব আলম চাষীর সঙ্গে দেখা করলে চাষী প্রেসিডেন্টের রুম থেকে ফিরে জানান, রাষ্ট্রপতি সব ঘটনাই জানেন।
সন্ধ্যার দিকে জেনারেল খলিল শুনতে পান, মেজর রশিদ গং দেশ ছেড়ে চলে গেছে। পরদিন বিকেলে বঙ্গভবনে কেবিনেট মিটিংয়ে জেলহত্যা বিষয়ে জানার জন্য তিন বাহিনী প্রধানকে ডাকা হয়। মিলিটারি সেক্রেটারির রুমে অপেক্ষা করার সময় তিনি কেবিনেট মিটিংয়ে খুব গোলমালের শব্দ শুনতে পান।
তখন দৌড়ে কেবিনেট রুমে গিয়ে খলিল দেখেন, কর্নেল সাফায়েত জামিল কয়েকজন আর্মি অফিসারসহ সশস্ত্র অবস্থায় কেবিনেট রুমে ঢুকে পড়েছেন। জেনারেল ওসমানী তাদেরকে গুলি না করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। সশস্ত্র অফিসারদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন ওসমানী।
পরে সাফায়েত জামিল খন্দকার মুশতাককে জেলহত্যা তদন্তে ইনকোয়ারি কমিশন গঠন এবং পদত্যাগে বাধ্য করতে পারলেও জেনারেল ওসমানীর বদৌলতেই সেদিন খন্দকার মুশতাক বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রমাণ হয়েছে, মুশতাককে ১৫ আগস্ট সকাল থেকেই পথমে পদ-পদবী ছাড়া এবং পরে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে সমর্থন করে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী।
তবে পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী হয়েছিলেন। আর জিয়া নিহত হলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে অন্য দল থেকে প্রার্থী হন জেনারেল ওসমানী।
(আগামীকাল ত্রয়োদশ কিস্তি: কুমিল্লার বার্ড থেকে ঢাকার আগামসি লেন)