আমি সাহিত্যের ছাত্র নই। কিন্তু সাহিত্য পাঠে ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন প্রথম ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পড়ি তখনই শওকত আলীর ভক্ত হয়ে যাই। একটি নির্দিষ্ট কালকে ধরে ঘটনার এমন অসাধারণ বর্ণনা, চরিত্রকে এত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা, সমাজ ও সমাজের মানুষকে এমন অবিকল রূপে তুলে ধরার যে যোগ্যতা শওকত আলী দেখিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যে সত্যিই বিরল। সাহিত্যরসিক মাত্রই শওকত আলীর ভক্ত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। আমিও তার ভক্ত হয়ে যাই।
একে একে পড়ি তার যাত্রা, অপেক্ষা, দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন, সম্বল, ওয়ারিশ, উত্তরের খেপ, দলিল, নাঢ়াইসহ বেশ কিছু উপন্যাস। লেলিহান সাধ, শুন হে লখিন্দর, বাবা আপনে যান-এই গল্পগ্রন্থগুলোও পড়া হয়ে যায়। তার প্রতিটি গল্প-উপন্যাসই অনন্য এবং অসাধারণ। তিনি তার লেখায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন, দেশভাগ, তৃণমূল মানুষ এবং তাদের প্রেম, দ্রোহ, জীবনসংগ্রামের কাহিনী গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই স্বতন্ত্র ও বহুমুখী, ফলে তাঁর একটি গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
এক সময় সংবাদে, চাকরি করার সুবাদে দেশের বিখ্যাত সব জ্ঞানী-গুণী-কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়। শওকত আলীকে প্রথম দেখি সংবাদে, ২০০১ সালে। আমি যখন সংবাদে ছিলাম সেই সময় (১৯৯৯-২০০৬) সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগের কক্ষটি ছিল দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের আড্ডাখানা। কেউ আসতেন সংবাদের সম্পাদক বজলুর রহমানের সঙ্গে আড্ডা দিতে। কেউ আসতেন সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে। কেউ বা আসতেন সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছে লেখা দিতে। মুনীরুজ্জামান, সোহরাব হাসানের কাছেও অনেক কলাম-লেখক আসতেন লেখা জমা দিতে। সেই সময় ‘ইমেইল’ কালচার চালু হয়নি। তাই লেখকরা হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি নিয়ে সরাসরি সংবাদে চলে আসতেন। তখন আমরা সবাই এক রুমে বসতাম। কাজেই কোনো একজন অতিথি এলেই তাঁকে ঘিরে আড্ডা জমে উঠত। আমি ছিলাম সেইসব রথী-মহারথীদের আড্ডার নীরব অংশগ্রহণকারী।
একদিন আমাদের সকলের প্রিয় মকবুল ভাই (মকবুলার রহমান, সংবাদে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন) আমার সঙ্গে শওকত আলীর পরিচয় করিয়ে দেন। শওকত আলীকে উদ্দেশ করে মকবুল ভাই বলেন, ‘ওর নাম চিররঞ্জন, ও হচ্ছে আপনার এলাকার মানুষ। বাহের দেশের লোক!’ আমার বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদায় জেনে শওকত আলী খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। আমি সেদিনই জেনেছিলাম, শওকত আলীর বাড়িও দিনাজপুরে। যদিও তিনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, দেশবিভাগের পর তিনি স্থায়ীভাবে দিনাজপুরে চলে আসেন।
যাহোক, প্রথম পরিচয়ের দিনেই তিনি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষকে কেন ‘পলিয়া’ বলে ডাকা হয়, ‘ডাঙ্গর’ শব্দটির মানে কি ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন। অসাধারণ তাঁর নৃতাত্ত্বিক ও ইতিহাস জ্ঞান। খুব গুছিয়ে রস-মিশিয়ে কথা বলতেন। আর কিছুক্ষণ পর পর ‘এক কাপ লাল চা’ খুব আয়েশ করে খেতেন।
এরপর সংবাদের সম্পাদক বজলুর রহমানের জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ হয়। শওকত আলী মাঝে মাঝে বজলু ভাইয়ের কাছে আসতেন। আমাকে বজলু ভাইয়ের রুমে ডেকে নিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি, সংগ্রামী ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। এসব আলোচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি ছিলাম কেবল শ্রোতার ভূমিকায়! একটু ‘হু-হা’ করা ছাড়া সত্যিকার অর্থেই আমার জ্ঞান-গরিমা এ ধরনের বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আলাপ চালানোর মতো যথেষ্ট ছিল না!
শওকত আলীকে আমার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কিন্তু সদালাপী একজন মানুষ মনে হয়েছে। সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষ, ইতিহাস-নৃতত্ত্ব বিষয়ে যার ছিল অগাধ জ্ঞান। তাঁর মধ্যে শিক্ষকসুলভ একটা প্রবণতা ছিল। বলতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো ছিল মন দিয়ে শোনার মতো। তাঁর কথা শুনে মনে হতো, যেন নিজের লেখা একটি গল্প বা উপন্যাস তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন!
আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য, যে এমন একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তাঁর মতো সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে আর আসবে কিনা সন্দেহ! যদিও প্রতিভা আর সৃষ্টির তুলনায় তিনি খুব কম আলোচিত বা মূল্যায়িত হয়েছেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। একালের পাঠকেরা শওকত আলীর লেখা বড় বেশি পড়েছেন বলে মনে হয় না।
শওকত আলী নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। এমন শিল্পগুণসম্পন্ন লেখক আমাদের দেশে খুব কমই জম্মেছেন। গল্প-উপন্যাসে গণমানুষের কথা, তাদের যাপিত জীবন, জীবন-সংগ্রাম, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কথা এত নিখুঁত বর্ণনায় অন্য কেউ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না।
বাংলাভাষাভাষি হিসেবে আমাদের গর্ব যে আমরা একজন শওকত আলীকে পেয়েছিলাম। আর জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে গ্লানির বিষয় হলো, আমরা শওকত আলীকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি!
এমন মানুষের চলে যাওয়ার খবর শুনে যার পর নাই আহত হয়েছি! তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনী ও বর্ণনাগুলো, আর তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারাটি কেবলই চোখের সামনে ভাসছে! যখন দেখি চারপাশের মেরুদণ্ডগুলো কেবলই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, নুয়ে পড়ছে, তখন আমৃত্যু মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটা শওকত আলীর কথা বড় বেশি মনে পড়ছে!
তিনি তার জীবন-সাধনা ও সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে যে অবদান রেখে গেছেন তা নিঃসন্দেহে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়:
‘‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।
তাই
চিহ্ন তব পড়ে আছে,
তুমি হেথা নাই।’’
পরিশেষে এই মহান সাহিত্যিকের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)