দৈনিক সংবাদের জলসা আর ইত্তেফাকের তরুণ কণ্ঠের জন্যে আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম আমি। সেই অভিজ্ঞতা আমার সাংবাদিকতা জীবনের এক বিশেষ ঘটনা হয়ে আছে আজও। তখন আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন অনেকটাই তরুণ। কিন্তু ওই বয়সেই সে তার জাদুকরী গান আর গিটারের দ্যোতনার মাতিয়ে চলেছে গোটা দেশ। আর খুব অল্প সময়ের ভেতরে ওই সময়ে তরুণ তরুণীদের আইকনে পরিণত হন তিনি।
তার উত্থান, জনপ্রিয়তা ও সফলতার সময়টা কাছ থেকে দেখেছি। আইয়ুব বাচ্চু চ্যানেল আই পরিবারের একজন ছিলেন। আমার বস ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এর সাথে তার পিতা পুত্রের সম্পর্ক।
চ্যানেল আই এর বড় বড় সব ইভেন্টে ছিল তার সরব উপস্থিতি। আমাদের চ্যানেলে অনেক থিম সং আইয়ুব বাচ্চুর করা। তাই তিনি আমাদের সবার আত্মার আত্মীয়। শেষ বিদায় বেলায়ও এজন্যে বাচ্চু ভাই আসলেন তার প্রিয় চ্যানেল আই ভবনে।
নামাজে জানাযা আর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই আমরা পুরো চ্যানেল আই পরিবার। বাচ্চু ভাইয়ের বিদায় বেলায় ভেজা চোখে বারবার মনে পড়ে- নব্বই এর দশকে সে কি উন্মাদনা মানুষের বাচ্চু ভাইকে ঘিরে। একের পর এক সুপার হিট গান উপহার দিচ্ছেন শ্রোতাদের আর লাইভ কনসার্টে তিনি তো ছিলেন অনবদ্য। তার গিটারের ঝংকারে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো সব বয়েসি মানুষ। আইয়ুব বাচ্চুর সাথে আমার আরেকটি বিশেষ স্মৃতি আমার লেখা দুটি গানে সুর দিয়েছিলেন তিনি। আর সেই গান দু’টি গেয়েছিলেন জনপ্রিয় শিল্পী মেহেরীন ও তিশমা।
তিনি নিজে লিখতেন, সুর দিতেন ও একই সাথে গাইতেন। আইয়ুব বাচ্চু তাঁর নিজের স্থান থেকে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতকে শতভাগ দিয়ে গেছেন। তিনি একজন পারফেক্ট গিটারিস্ট, টিউনার এবং সিঙ্গার।
তরুণরা কেন তাকে ফলো করে? এই ফলো করার জিনিস তিনি তরুণদেরকে দিয়েছেন। বাচ্চু ভাই গানের জগতে আসেন ব্যান্ড ফিলিংস-এর মাধ্যমে। এর আগে বন্ধুদের সাথে ছোটখাট অনুষ্ঠান করতেন। কিন্তু ১৯৭৮ সাল থেকে ফিলিংস-এর সাথে তিন বছর তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে ইংরেজি গান করেছেন। সত্তরের দশক থেকে বাংলাদেশে শ্রোতাদের কাছে ইংরেজি গান, হার্ড-রক, ব্লুজ, অল্টারনেটিভ রক, ব্যান্ড মিউজিক এসব জগতের পরিচয় হতে থাকে তাঁর গানের মধ্য দিয়ে।
১৯৮০ সালের দিকে তিনি সোলস ব্যান্ডের সাথে গান করতেন। এই দলের সাথে তিনি ১০ বছর যুক্ত ছিলেন। তারপর ১৯৯১ সালে তিনি গঠন করেন এলআরবি। তিনি একক অ্যালবাম করেছেন ১৬টি। আর ব্যান্ড অ্যালবাম করছেন ১২টি। এর মধ্যে কষ্ট এবং ফেরারি মন – এই দুটি অ্যালবামের গান বাংলাদেশের বড় শহর ছাড়িয়ে ছোট ছোট শহরেও আইয়ুব বাচ্চুর নামকে পরিচিত করে তোলে। নব্বইয়ের দশকে আইয়ুব বাচ্চুর এসব হিট অ্যালবামের প্রভাব পরে বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। চার দশকেরও বেশি সময় তিনি নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন সুর ও সঙ্গীতে। তার রূপালি গিটারে বুঁদ হয়নি এমন শ্রোতা মেলা ভার। কিন্তু সুরের মায়াজাল ছিন্ন করে সত্যিই চলে গেছেন তিনি। ভারতীয় উপমাহাদেশে গিটার বাদনে তার ছিল শিখর ছোঁয়া অবস্থান।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত রক্তগোলাপ তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তবে অ্যালবামটিতে তেমন সাফল্য আসেনি। সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ময়না’র মাধ্যমে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এই অ্যালবাম এই শিল্পীর গোটা জীবনেই একটা মাইলফলক করে। এর পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। একে একে সুপারহিট সব গান উপহার দিয়ে গেছেন কিংবদন্তী এই কণ্ঠশিল্পী। ৪০ বছরের দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে তার সুপারহিটের গানের সংখ্যা কত?- প্রশ্নের উত্তর দিতে ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হবে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে তার গাওয়া প্রায় সব গানই সুপারহিট। তার ‘চলো বদলে যাই’ শিরোনামের গানটির কথা না বললেই না। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত সুখ অ্যালবামের এই গানটি আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসেবে বিবেচিত। কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশি গানটির কথা এবং সুরও তার নিজের।
নব্বইয়ের দশক থেকেই এমন কোনো লাইভ অনুষ্ঠান নেই, যেখানে দর্শক-শ্রোতারা এই গানটি গাওয়ার জন্য আইয়ুব বাচ্চুকে অনুরোধ করেননি। এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে। সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে’। গানটিতে গিটারের প্রতি আইয়ুব বাচ্চুর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।
এছাড়া বিভিন্ন অ্যালবামে গাওয়া মেয়ে তুমি কি দুঃখ চেনো, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি, পত্রমিতা বন্ধু তোমায় বেসেছি যে ভালো, এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে, আরও বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে, চোখ বুজিলে হবে অন্ধকার, সাক্ষী থাকুক বিশাল আকাশ, গানগুলোও যে কোনো লাইভ অনুষ্ঠান ও কনসার্টে ঝড় তোলার পক্ষে যথেষ্ট। বাংলা চলচ্চিত্রেও আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় গানের সংখ্যা কম নয়। সিনেমার জন্য তিনি প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৯৭ সালে। ওই বছর কাজী হায়াত পরিচালিত এবং মান্না মৌসুমী অভিনীত লুটতরাজ ছবির অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে গানটিতে প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি।
সেই গানে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কনকচাঁপা। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কনকচাপার সঙ্গে দ্বৈতভাবে গাওয়া তার ওই গানটি। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালে আইয়ুব বাচ্চুকে দিয়ে আবার চলচ্চিত্রে গান করান পরিচালক কাজী হায়াত। ওই বছরে মুক্তি পাওয়া আম্মাজান ছবির আম্মাজান আম্মাজান তুমি বড়ই মেহেরবান গানটিতে কণ্ঠ দেন বাচ্চু। মান্না ও মৌসুমী অভিনীত সে ছবি তো হিট হয়েছিলই, দর্শক তারচেয়েও বেশি মশগুল হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর এই গানটির প্রতি। আম্মাজান ছবিতে তার আরো একটি গান ছিল। সেটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এতো মানুষের ভালবাসা আর জনপ্রিয়তাকে পেছনে ফেলে রূপালি গিটারের জাদুকর চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
কাছ থেকে তার শেষ যাত্রা দেখলাম। আর নানা অনুষ্ঠান ও কাজের সান্নিধ্যে বারবার গিয়ে দেখেছি- বাচ্চু ভাই ছিলেন একজন অহংকারহীন,পরোপকারী ও প্রকৃত শিল্পীর মনের দরদী এক মানুষ। কোনদিন ভুলবো না বাচ্চু ভাই আপনাকে। আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের চেতনায় হাজার বছর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)