১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিরা রাজাকার শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধা সামরিক বাহিনী হচ্ছে রাজাকার। অখণ্ড পাকিস্তানি বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয় এটি। মূলত যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে রাজাকার দল সৃষ্টি হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। খানজাহান আলী রোডে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াতে ইসলামী কর্মীর সমন্বয়ে জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহকারী আমির মওলানা এ কে এম ইউসুফ প্রথম ‘রেজাকার’ বাহিনী গঠন করেন। রেজাকার শব্দটি জনগণের মুখে মুখে ‘রাজাকার’ শব্দে পরিণত হয়।
পরবর্তীকালে দেশের অন্যান্য অংশেও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স– ১৯৭১ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রুপান্তরিত করেন। তবে এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকারবাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়।
রাজাকার বাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং সমাপ্ত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল এ কে নিয়াজী ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বব সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদায় উন্নীত হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটে। এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আল শামস ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধাদের বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করা।
রাজাকার বাহিনীর পরই গঠিত হয় আলবদর বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতের প্রচারযন্ত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর মাধ্যমে ‘দুষ্কৃতকারী’দের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও যুদ্ধের ডাক দিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। আর সে বাহিনীর আমিরের পদ গ্রহণ করলে তৎকালীন ছাত্রসংঘের কর্ণধার মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আল শামস ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। মে মাসে রাজাকার বাহিনী গঠনের আগেই এপ্রিল মাসে গঠিত হয় আলবদর বাহিনী।
একপর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের আমির ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী আলবদর ও আল শামস বাহিনীর আমিরের পদ গ্রহণ করেন এবং সারা বাংলাদেশে প্রচারণা, সামরিক বাহিনীসমূহের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঢাকা নগর ছাত্রসংঘের আমির ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এসব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল কাদের মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের আঙ্গুল কাটার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তাদানকারী আধা-সামরিক বাহিনী হলো আলবদর। যার সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অখণ্ড রাখার উদ্দেশে একটি জনমত গঠন করার লক্ষ্যে পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় ২২ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মুহাম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর শহরে। ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধকে কথিত আদর্শ করে এই বাহিনী গঠিত হলেও এদের মূল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া। আর নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণে সহায়তা করা।
আলবদর বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল সীমাহীন। রাজাকার বাহিনী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, আলবদর বাহিনীর মূল কাজ ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক গণহত্যার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, পাকিস্তানবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করাই ছিল বাহিনীর মূল লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর পতনের পর এই বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে।
আল শামস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক মিলিশিয়া বাহিনী। এর সদস্য ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংঘঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় বেসামরিক লোকজনের ওপর পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইটের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। এক কথায় বলা যেতে পারে স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন দিতে প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল বাঙালি।
এমন পরিস্থিতিতেও রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী গড়ে উঠলো কী করে?
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এ দেশের কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও দল নিয়ে এ বাহিনী গড়ে তোলে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি। মুসলিম লীগ পরবর্তী সময়ে ভাগাভাগি হলেও তাদের কিছু প্রভাব জনগণের মধ্যে অব্যাহত থাকে। আর এদেরকেই ব্যবহার করে এ রাজাকার বাহিনীতে।
হানাদার বাহিনী ও তার দালালদের অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞের ফলে এক কোটির ওপর মানুষ ভারতে উদ্বাস্তু হলেও বাকিরা দেশেই থেকেই যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুষ্টিমেয় দালাল ছাড়া বাকি সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে। পাকিস্তানি শাসকরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পক্ষে তৎপরতা বন্ধ করার জন্য সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আইন করে রাজাকার, আল-বদর, আল শামস বাহিনী গড়ে তোলে এবং তাদের দিয়ে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে নানান অপতৎপরতা চালায়। দিন দিন মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা যতো বাড়তে থাকে রাজাকার, আলবদরদের অপকর্ম ততো বাড়তে থাকে।
সার্বিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিজয়ের পথে এবং যৌথ বাহিনী ৩ ডিসেম্বর থেকে চূড়ান্ত আঘাত শুরু করলো, তখন আলবদর, আল শামস বাহিনী তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন স্তরের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে হত্যা করে। ১০ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে এবং ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে হত্যা করা হয় শহীদুল্লা কায়সার, ডা.আবদুল আলিম, অধ্যাপক মুনির চৌধুরিসহ শত শত বুদ্ধিজীবীকে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এবং সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
বিজয়ের মুহূর্তে যখন আলবদররা তাদের অফিস ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন তাদের অফিস থেকে এক বস্তা মানুষের চোখ উদ্ধার করা হয়। তারা হত্যা করার আগে মানুষের চোখ উপড়ে রাখতো। হত্যাকাণ্ড পরিচালনার জন্য মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বধ্যভূমি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বিজয়ের পর ঢাকায় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা ওইসব বধ্যভূমিতে শত শত লাশ ভাসতে দেখেছেন।
এরপর বিজয়ের আনন্দে অশ্রুসিক্ত চোখে বাঙালি নতুন জীবন শুরু করলো। কয়েকজন রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর সদস্য সেদিন ধরা পড়েছিল। বাকিরা মিশে গেলো সাধারণ মানুষের মাঝে। তারপর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর জেল থেকে অনেক খুনি বের হয়ে এলো। পরবর্তীকালে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পাকিস্তানমনা কর্মকর্তাদের পদচারণা ছিল লক্ষণীয়। এছাড়া পাকিস্তান থেকে ফেরত সব সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে পুনবর্হাল করা হয়।
এদেশের গ্রামে একটি প্রবাদ আছে ‘সাপ মেরে লেজে বিষ রাখতে নেই’। অথচ আমরা সেসময় থেকে বিষ রেখে দিয়ে ছিলাম। আর সেই সাপ ৭২, ৭৩, ৭৪-এর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মন্দার সুযোগ শক্তি সঞ্চয় করে ৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনার জন্ম দেয় এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সফল হওয়ার পর এখনো অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিয়েই শেষ হয়নি। এখনো নীরবে বুদ্ধিজীবী হত্যা অব্যাহত আছে। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই স্বাধীন দেশে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর রাজাকারদের বর্বরোচিত হামলা। যাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করা হয়েছিল। এছাড়া বর্তমানেও রাজাকার, আলবদর, আল শামসের লোকজন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।
এদেশের জনসাধারণের দাবি ছিল এসব রাজাকার আলবদর, আল শামসদের তালিকা প্রকাশ হোক৷ আর এদের সকল অপকর্মের বিচার যেন বাংলার মাটিতে হয়। শেখ হাসিনার সরকার জনগণের সেই চাওয়াকে পূরণ করতে সদা সচেষ্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিজয়ের ৪৮ বছর পর রাজাকারদের তালিকা উন্মোচন হতে শুরু করেছে। এবারের বিজয় দিবসে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)