সবার স্বপ্ন জুড়ে চলচ্চিত্র। দেশ বিদেশের ওরা মিলেছে রংধনুর রং ছড়িয়ে নির্মাণের পাঠশালায়। বাংলাদেশসহ মোট ৮টি দেশের ২৮ জন। ৮ম ঢাকা সিনে ওয়ার্কশপ-এ অংশগ্রহণকারী ২৮ জনের চলছে ১৬ দিনের কর্মশালা। ৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই নির্মাণ শিক্ষার যজ্ঞ চলবে ২০ জানুয়ারি। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ এই চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালার বাকী দুই সহযোগী পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট ও রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি। এখান থেকে নির্মিত ১০টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে উৎসবে।
১৯ জানুয়ারি বিকালে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে প্রদর্শিত হবে কর্মশালায় অশগ্রহণকারীদের তৈরী ১০টি চলচ্চিত্র। উৎসেবের সমাপনী দিনে অংশগ্রহণকারীদের সনদ বিতরণ করা হবে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে এই কর্মশালায়। প্রত্যেকেই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের। প্রথম বর্ষের ছাত্রী বিবি চাঁদ সুলতানা। প্রথমবারের মত এমন কোন কর্মশালায় অংশগ্রহণ তার। তারুন উচ্ছ্বসিত রংপুরের মেয়ে বিবি। জানান, বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বাঁছাই করে পাঠিয়েছে। ক্যাম্পাসে থাকতেই বিভিন্ন ধরণের ভিডিও বানাত। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরে ছিল। ভিসি নাজমুল আহসান কালিমুল্লার ঐকান্তিকতায় তারা এমন কর্মশালায় আসতে পেরেছেন বলে জানান বিবি। কর্মশালায় অংশগ্রহণের ফি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে বলে জানান বিবি।
কর্মশালায় তারা নির্মাণ করছেন পথের খাবার বা স্ট্রিট ফুড নিয়ে ৫ মিনিটের সিনেমা। বিবি চাঁদের ভূমিকা সহকারী পরিচালকের। দলে তারা ছয়জন আছেন। নেপালের ১ জন ও বাংলাদেশের পাঁচজন। নেপালের আভাস এবং বাংলাদেশের মিতালি পরিচালনা করছে চলচ্চিত্রটি। দেশ-বিদেশের মিলে কাজ করতে কেমন লাগছে প্রশ্নে চাঁদ সুলতানা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এ অভিজ্ঞতা বলে বোঝাবার মত নয়। সবার সঙ্গে ভাবনা বিনিময়। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। অসাধারণ। ছোট জীবনে অনেক বড় পাওয়া। আমাদের কোর্স পরিচালক বিদেশী। পরিচালকের একজন বিদেশী। ভাষার বিষয়ে প্রথমে একটু জটিলতা হতো। কয়েকদিন একসঙ্গে থাকায় সে জড়তাও উধাও হয়ে গেছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এসএম তানভীরুজ্জামানদের দল পাঁচজনের। তারা নির্মাণ করেছে নদী দূষণ এবং চারপাশের পরিবেশ নিয়ে চলচ্চিত্র। কামরাঙ্গীরচর বেঁড়িবাঁধ, সংলগ্নবস্তি, সদরঘাট ঘুরেছে দেশি-বিদেশী তারা পাঁচজন। এটা এক জীবনের অভিজ্ঞতা হয়ে দাড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন তানভীর। পাশাপাশি দেশের বাইরে থেকে যারা এসেছে তাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেছেও বলে জানান তানভীর।
কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে আসা কোয়েনা চ্যাটার্জি প্রথম ঢাকায় এসেছেন। কর্মশালায় তিনটি সিনেমা প্রকল্পে কাজ করছেন তিনি। কোনটিতে প্রযোজনা, কোনটিতে কাস্টিং আবার কোনটিতে ক্যামেরার সামনে। সব মিলিয়ে এলাহী কারবার। স্কটিশ চার্চ কলেজে মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স পড়ুয়া কোয়েনার মা স্কুল টিচার, বাবা ব্যবসায়ী। চাচা চলচ্চিত্র নির্মাতা। উৎসবেও অংশ নিয়েছে তার চাচা। একাই চলে এসেছে কোয়েনা। প্রতিবেশী বাংলাদেশের কথা অনেক শুনেছেন বাবা-মা-চাচার মুখে। এসে অনুভূতিও দারুন। খাবার মানুষ সব কিছুত দারুন লাগলেও চরিম বিরুক্তি কেবল শহরের ট্রাফিক জ্যামটাতে।
প্যালেস্টাইনের তরুণী দিনা আমিন। থাকেন লন্ডনে। উৎসবে তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রাইজ আপ’ ইতিমধ্যে প্রদর্শিত হয়েছে। ৪ জানুয়ারি ঢাকায় এসেছেন। এই প্রথম। তবে ১৫ দিনেই নতুন আলোয় চিনে নিয়েছেন একটি প্রাণোচ্ছল দেশকে। কর্মশালায় অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে দিনা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নানান দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে ইচ্ছুক এবং নির্মাতাদের সঙ্গে এই কর্মশালা আমাকে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে। বিশেষ করে কর্মশালাটির বিষয়বস্তু এবং প্রস্তুতি দারুন সমৃদ্ধ। লন্ডনে বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি বাংলাদেশ তার চাইতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ এবং জয়ফুল। এদেশের সংস্কৃতিও ভীষণ বর্ণিল। দারুণ লেগেছে। আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়েও বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন এ দেশের প্রতি ভালোবাসাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের বাছাই করে কর্মশালা পর্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়ার তদারকিতে রয়েছে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস। ৭টি বিদেশি দেশের ১০ জন কর্মশালায় অংশ নিচ্ছেন। দেশগুলো হল ভূটান, ইন্ডিয়া, ইরান, নেপাল, প্যালেস্টাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউক্রেইন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৮ জন অংশ নিচ্ছেন এই প্রশিক্ষণ যজ্ঞে।
উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতাবা জামাল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মূলত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা এই আয়োজন রেখে আসছি গত ৮ আসর ধরে। একটি সুস্থ সৃজনশীল এবং প্রশিক্ষিত সিনেমা নির্মাতা-সমালোচক প্রজন্ম তৈরীর প্রয়াস এটি।’ তিনি আরো বলেন, কর্মশালায় চলচ্চিত্র শিক্ষায় নন্দনতত্ব এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র ফান্ডিং সম্পর্কে অবগত করা ও বিশ্বের বিভিন্ন উৎসবে নিজেদের নির্মাণ কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায় তার ওপর কর্মশালায় জোর দেওয়া হয়।
কর্মশালার প্রধান পরিচালক আমেরিকান অভিদিও সালাজার। পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে নাম হয়েছে আবদাল লতিফ। পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতার ৩৫ বছরের বর্ণাঢ্য নির্মাতা জীবন। থিয়েটারে পড়াশোনা করা এবং পরবর্তীতে তুলনামূলক ধর্মতত্বের ওপর পড়াশোনা। বেশ কয়েক বছর ধরে বিবিসি’র হয়ে পবিত্র মক্কা এবং মদীনার ওপর ধারাবাহিক ভাবে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে চলেছেন। বাংলাদেশে প্রথম এসেছেন এমন কর্মশালা পরিচালনা করতে। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমি অভিভূত। শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থে দারুন মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অনুভূতিপ্রবণ। আমি সব সময় মনে করি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে চলচ্চিত্র শিক্ষাটা জরুরী। ফলে কারিগরি দিকের চাইতে তাদের চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা আগে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এটুকু বোঝাতে চয়েছি, কারগিরি দিক শিখে নেওয়া যাবে কিন্তু ভালোবাসাটা শেখানো যায়না। সেটা থাকতে হবে।’
ছবি : ফয়সাল জাফর