Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

যে নৃশংসতা থেকে রাজপরিবারের সদস্যদেরও রেহাই নেই

সৌদি রাজপরিবার

আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পন্ন সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির অন্তর্ধান ও হত্যার মধ্য দিয়ে বর্তমানে সৌদি প্রশাসনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বিশ্বজুড়েই প্রবল হয়ে উঠেছে।

তবে এটাও সত্যি, সৌদি সরকার শাস্তির ব্যাপারে বরাবরই খুব কঠোর; সেই শাস্তি কোনো অপরাধের দায়েই হোক, বা রাজপরিবারের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে। সেই শাস্তি থেকে সাধারণ নাগরিক তো দূরের কথা, খাশোগির মতো প্রভাবশালী সাংবাদিক, এমনকি রাজপরিবারের সদস্যও রেহাই পান না।

জামাল আহমাদ খাশোগি ছিলেন সৌদি প্রশাসন ও রাজপরিবারের একজন কট্টর সমালোচক। তার জন্ম ১৯৫৮ সালে মদিনার একটি ধনী, প্রভাবশালী ও স্বনামখ্যাত পরিবারে। তার দাদা মুহাম্মদ খাশোগি সৌদি আরবের সাবেক বাদশাহ আব্দুল আজিজ আল সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন।

সৌদির প্রভাবশালী অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগিরও নিকটাত্মীয় জামাল খাশোগি। ব্রিটেনের প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেমিক দোদি ফায়েদও (সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়ানার সাথে নিহত) ছিলেন জামালের চাচাত ভাই।

আর এই প্রভাবশালী ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণেই হয়তো সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে খাশোগির আত্মবিশ্বাস ছিল বেশি।

প্রিন্সেস মিশাল
সমালোচনার জন্য খাশোগির প্রাণ যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কেননা সৌদির ইতিহাসে এমন আরও ঘটনা আছে, যেখানে মত বা চিন্তাধারার মিল না হওয়ার কারণে রাজপরিবারের নৃশংসতায় জীবন দিতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদেরকেই।

এমনই এক নৃশংসতার উদাহরণ প্রিন্সেস মিশাল বিনতে ফাহাদ বিন মোহাম্মদ আল সৌদের মৃত্যু।

প্রিন্সেস মিশাল ছিলেন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন আবদুল আবদুল আজিজের (তৎকালীন বাদশাহ খালিদ বিন আবদুল আজিজের বড় ভাই) নাতনি। ব্যাভিচারের অভিযোগে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল সৌদি রাজতন্ত্র।

লেবাননের বৈরুতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করার সময় লেবাননে সৌদি রাষ্ট্রদূতের ছেলে খালেদ আল-শায়ের মুলহাল্লালের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জাড়িয়ে যান মিশাল। রাজপরিবারের বাইরে নিজের ইচ্ছায় এই প্রেমের সম্পর্ক পরিবারের নীতিবিরুদ্ধ জানার পরও সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি দু’জনের কেউই।

সৌদি রাজপরিবার
মিশাল ও খালেদের মৃত্যুদণ্ড

ভালোবাসার সম্পর্কের এক পর্যায়ে শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও দু’জনে লুকিয়ে বিয়েও করেন।

’৮০-এর দশকের ঘটনা। প্রিন্সেস মিশালকে হঠাৎই সৌদিতে ডেকে পাঠানো হয় তারই এক আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য, যিনি প্রায় মিশালের বাবার বয়সী। ওই সময় ডুবে মারা যাবার অভিনয় করে খালেদের সঙ্গে দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করেন প্রিন্সেস মিশাল। কিন্তু ছেলে সেজে জেদ্দা বিমানবন্দরে গেলেও পাসপোর্ট দেখাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান তিনি। পুলিশ তাকে আটক করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

রাজপরিবারের নিয়মনীতির ভয় না করে ওই সময় মিশাল নিজেই খালেদের সঙ্গে প্রেম এবং শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। ব্যাভিচারের শাস্তি হিসেবে শরিয়াহ আইন মোতাবেক তাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই মিশালের মাথায় পরপর বেশ কয়েকটি গুলি করে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও করা হয়।

অন্যদিকে ব্যাভিচারের অভিযোগ আনা হয় খালেদের বিরুদ্ধেও। তবে ব্যাভিচারের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় রাজতন্ত্রের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন রাজকন্যাকে ভালোবাসার ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল ওই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ধরণে।

প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তলোয়ারের এক কোপে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলার কথা ছিল খালেদের। কিন্তু পেশাদার জল্লাদের বদলে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন রাজপরিবারেরই একজন সদস্য। এমনকি নিষ্ঠুরতার মাত্রা বাড়াতে এক কোপে নয়, ধীরে ধীরে চারটি কোপ দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

পরিবারের সিদ্ধান্ত না মেনে নিজের মতে ভালোবাসার এই দণ্ডের কথা গোপন করতে চেয়েছিল সৌদি আরব। কিন্তু ১৯৮০ সালে  বিবিসি এবং পিবিএসে ‘ডেথ অব আ প্রিন্সেস’ ডকুড্রামা নির্মাণের ফলে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।

বাদশাহ ফয়সাল
এ ঘটনার অল্প সময় আগে, ১৯৭৫ সালে নিহত হয়েছিলেন বাদশাহ ফয়সাল। আপন ভাতিজা প্রিন্স ফয়সাল আবু মুসায়েদের হাতে প্রাণ হারান তিনি।

সৌদি প্রশাসনকে আধুনিকায়নের চেষ্টা, অতি রক্ষণশীল সৌদি আরবের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং বিশ্বজুড়ে ইসলামিক দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন ও রক্ষণশীল শক্তিগুলোকে একত্র করার প্রতি সমর্থনের জন্য পরিচিত ছিলেন বাদশাহ ফয়সাল। তার এসব চিন্তাধারা তৎকালীন সময়ের জন্য ছিল অস্বাভাবিক।সৌদি আরব-সাংবাদিক-জামাল খাশোগি

আরও তিন রাজপুত্র নিখোঁজ
জামাল খাশোগি নিখোঁজ হওয়া ও মৃত্যুর আগেই সম্প্রতি সৌদি আরবের তিন প্রিন্সের সঙ্গেই ঘটেছে গুমের ঘটনা। নিউজ.কম.এইউ জানায়, ২০১৫-২০১৬ – এ সময়ের মধ্যে ইউরোপ প্রবাসী প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কি বিন আবদুল আজিজ, প্রিন্স তুর্কি বিন বান্দার এবং প্রিন্স সৌদ বিন সাইফ আল-নাসরকে জোর করে সৌদি আরবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

প্রিন্স সুলতান বিন তুর্কি সৌদির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সরাসরি অভিযোগ এনেছিলেন। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে মিশরের উদ্দেশে প্লেনে চড়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। পরে জানা গিয়েছিল, পুরো প্লেনটিই সৌদি আরবের একদল কর্মকর্তার দখলে ছিল।

সাবেক পুলিশ প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন বান্দার রাজপরিবারের ক্ষমতার লড়াইয়ে জেলে গিয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে ২০১২ সালে প্যারিসে পালিয়ে সেখান থেকে ইউটিউবে সৌদি আরব সংস্কারের ভিডিও পোস্ট করতে থাকেন তিনি।

২০১৫ সালে তিনি দাবি করেন, প্রিন্স সুলতানের মতোই তাকে টেনেহিঁচড়ে দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে – এমন হুমকিসহ চিঠি পেয়েছেন তিনি। তার কিছু সময় পরই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।

প্রায় কাছাকাছি সময়ই হারিয়ে যান প্রিন্স সৌদ বিন সাইফ। ২০১৪ সাল থেকে তিনি সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে টুইট করতে শুরু করেন। মিশরীয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনায় জড়িত সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি করেন তিনি।

২০১৫ সালে তিনি বাদশাহ সালমানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের আহ্বান জানিয়ে লেখা দু’টি চিঠিতে প্রকাশ্যে সমর্থনও জানান। এ ঘটনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিযোগ তোলে সৌদি সরকার। এর কিছুদিন পর থেকেই নিখোঁজ প্রিন্স সৌদ।

Exit mobile version