বাংলা গানের ইতিহাসে কালজয়ী এক সুরস্রষ্ঠার নাম আলাউদ্দিন আলী। তার সুর, কথা কিংবা সংগীত পরিচালনায় অসংখ্য গান মানুষের মনে ও মননে। বাংলা চলচ্চিত্রের গানের ইতিহাসে আলাউদ্দিন আলী এমন শক্তিমান একটি নাম, গেল কয়েক দশকের যে কোনো জনপ্রিয় গানের সুরকারের নাম বলতে বললে চোখ বুজে বলে দেয়া যায় যে, জনপ্রিয় গানটি তার সুর করা! সুরের জগতে এমন ব্যাপকতার জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি!
শেষ পর্যন্ত থেমে যেতে হলো তাকে। শেষ কয়েক বছরের মধ্যে কয়েক দফায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করে আবার সেরেও উঠছিলেন। প্রত্যয়ী ছিলেন, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার সুরের জগতে ফিরবেন। এমনকি শেষ কয়েক মাস করোনায় ঘরে শুয়ে শুয়েই কিছু গান তৈরীর পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু আর ফেরা হলো না। হলো না নতুন গানে সুর দেয়া। রবিবার (৯ আগস্ট) বিকেলে দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে তিনি পাড়ি দেন অজানা ভুবনে!
কোনো এক বন্ধু দিবসের ডামাডোলে বাংলায় খ্যাতনামা গান ‘বন্ধু তিন দিন পর বাড়ি গেলাম’ নিয়ে কথা হয়েছিলো আলাউদ্দিন আলীর সাথে। সেসময় জানিয়েছিলেন, গানটি নিয়ে পূর্বাপর ইতিহাস। কীভাবে গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো গোটা বাংলাভাষি মানুষের কাছে।
আশির দশকের শুরুতে ‘কসাই’ নামের সিনেমায় কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা কণ্ঠ দেন গানটি। সে সময়তো বটেই এরপরও গানটি মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। এমনকি এখনও গানটি কোথাও বাজতে শুনলে এমন কোনো বাঙালি শ্রোতা পাওয়া যাবে না যে, গানটির সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন না!
তিনি বলেছিলেন, যেসময় গানটি সৃষ্টি হয় সেসময় আমরা অনেকেই প্রায় প্রতিদিন গাজী মাজহারের বাড়িতে বসতাম। তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। যারা যারা গান লিখতেন সবাই একসঙ্গে বসতাম। নতুন লেখা গান নিয়ে কথা বলতাম। কথার ছলে হারমোনিয়াম বাজাতাম। গানের নতুন কথা বেরিয়ে আসলে ওখানেই সুর করে ফেলতাম। এমনই এক বৈঠকে একদিন ‘বন্ধু তিন দিন’ গানটা বেরিয়ে আসে গাজী মাজহারের লেখনীতে। আর আমিও হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুরটা তুলে ফেলি। গান লেখা ও সুর করার পরে আমরা ভাবতাম আসলে কাকে দিয়ে গানটি গাওয়ানো যায় বা এরকম ধাঁচের গানটি কার গলায় মানাবে সেটি নিয়েও ভাবতাম। সেই হিসেবে প্রথমে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। কিন্তু পরবর্তিতে ‘কসাই’ ছবিতে গানটি গেয়েছিলেন রুনা লায়লা।
যে গান বছরের পর বছর মানুষের মুখে ফিরে সেটাইতো কালজয়ী। এই হিসেবে আমার সুর করা ম্যাক্সিমাম গানই কালজয়ী গান। শুধু ‘বন্ধু তিনদিন’ নয়, বরং আমার কোনো গান হিট হয়নি এমনটা পাওয়া যাবে না। যদিও অন্যান্য গানগুলোর তুলনায় ‘বন্ধু তিন দিন’- একটি হালকা গান। তবে সর্বকালের হিট গান!-বলেছিলেন আলাউদ্দিন আলী।
নিজের সৃষ্টি নিয়ে যেমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণেও বেশ সোচ্চার ছিলেন আলাউদ্দিন আলী। নিজের সৃষ্টির স্বত্ত্ব নিয়ে বরাবরই কথা বলে গেছেন সংগীতের এই কিংবদন্তী। চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার ‘মেধাস্বত্ত্ব’ নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন রাখেন।
সেই আলাউদ্দিন আলী নেই। কিন্তু তার কালজয়ী সুর পৃথিবীতে রয়ে গেছে। যতোদিন সংগীত থাকবে, তার সুর আনন্দ বেদনায় বাঙালির নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হয়ে পাশে থাকবে! এমনটাই প্রত্যাশা সংগীত সংশ্লিষ্টদের।