পাহাড়ে বসতি স্থাপনের জন্য যত্রতত্র পাহাড় কাটা আর বৃক্ষ নিধন চলছে। ভঙ্গুর এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের কোলে বসবাসরত পরিবারগুলোকে অন্যত্র পুনর্বাসন না করায় প্রতি বর্ষায় পাহাড় ধসছে, ঝরছে জীবন।
চট্টগ্রামে প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়সাড়া ভূমিকাতেই প্রতি বর্ষায় মাটি চাপা পড়ে মানুষ নিহত হওয়াটা নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দু’টি পরিবেশবাদী সংগঠন। এজন্য চট্টগ্রামে পাহাড় ধস এবং মানুষের প্রাণহানীকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বলেই মনে করে দীর্ঘদিন পাহাড় সংরক্ষণের দাবিতে সোচ্চার সংগঠনগুলো।
হাউজিং-রিয়েলএস্টেটের নামে পাহাড়কাটা চলছে এবং ন্যাড়া এসব পাহাড়ি ভিটায় প্রভাবশালীদের সস্তা ভাড়ার ফাঁদে পড়ছে দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা দরিদ্র পরিবারগুলো। কম দামে মাথাগুঁজতে এসে মাটির নিচে পরিবার-পরিজনের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়া মৃত্যুতে কেবল শোকের মাতম ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না এসব অসহায় মানুষের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ড. এম. এ মতিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের পাহাড়গুলো একেবারে কঠিন শীলার নয়। তাই পাহাড় কাটায় দীর্ঘদিনে শক্ত হওয়া উপরিতল ধ্বংস হচ্ছে। নিচের নরম মাটিতে বর্ষায় ঢল ঘটাচ্ছে ভূমিধস। এছাড়াও নির্বিচারে পাহাড়ের মাটি ধরে রাখা বড় বড় বৃক্ষ নিধন চলছে। বড় গাছ কাটতে গিয়ে পাহাড়ের ঢালে প্রথমে ফাঁটল দেখা দিচ্ছে। বর্ষায় সেসব ফাঁটল পানিতে দুর্বল হয়ে বড় একটি অংশই ধসে পড়ছে। তাই পাহাড় ধসে মানুষ নিহত এখন প্রতি বর্ষায় চট্টগ্রামের চেনা খবর হয়ে উঠেছে।’
একশ্রেণীর প্রভাশালী নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে আশ্রয় খোঁজা দরিদ্র মানুষদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের গবেষণা কর্মকর্তা মো. হাসান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় সংরক্ষণে জন্য আমরা মামলা করেছিলাম। হাইকোর্ট এই আর্জির স্বপক্ষে নির্দেশ জারি করেছিলেন। অথচ এখনো সকল নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাহাড় কাটা চলছে। আমরা বর্তমানের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে এবার প্রভাবশালী যারা নির্দেশ মানছে না তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
২০০৭ সালে পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ১’শ ২৭ জন নিহত হওয়ার পর সরকার ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠন করে। তবে সেই কমিটিও পাহাড়কে নিরাপদ করতে পারছে না বলে জানান হাসান।
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে বসবাসরত দরিদ্র পরিবারগুলোর পুর্নবাসনের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বর্ষা এলেই শুধু নিরাপদে সরে যাওয়ার মাইকিং এবং বসতি উচ্ছেদ কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের ১০ ভাগও এখনো নিরাপদে সরে আসেনি। এ নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হম্বিতম্বি করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে এখনো অসংখ্য মানুষের বসবাস আছে। শুধু চট্টগ্রাম মহানগরীরই ১১টি পাহাড়ের নিচে এখনো ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রায় ৭’শ পরিবার বসবাস করছে। এসব পাহাড়ে আবাসন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা।’
মঙ্গলবার শেষ খবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পাহাড় ধসে ৬ সেনা সদস্যসহ কমপক্ষে ৮১ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। চট্টগ্রামের ধোপাছড়ি এলাকাতে ১৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সেখানে মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশে বান্দরবান সীমান্তে ধোপাছড়িতে ৪ জন ও রাঙ্গুনীয়া উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুরে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে সোমবার রাতে পাহাড় ধসে কমপক্ষে ৪১ জন মারা গেছে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি শহরে ১১জন ও কাপ্তাই উপজেলায় ৩জনের মৃত্যু হয়েছে। বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানেও পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৩ শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।