‘৩৩ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় কবিতার চরণটি জো বাইডের জীবনের সঙ্গে প্রায় মিলেই যাচ্ছিলো। এবারও না হলে হয়তো তিনি বলতেন-‘কেউ কথা রাখেনি’! কেননা, দিনটির জন্য ১৯৮৭ সাল থেকে অপেক্ষা ছিলেন মার্কিন ঝানু রাজনীতিবিদ। বারবার চেষ্টার পরও ভাগ্য তার সহায় হয়ে উঠছিলো না। তবুও তিনি বলেছেন, তিনি ভাগ্যে বিশ্বাস করেন। তার জীবনে যা হয়েছে সবই ভাগ্যের জোরে!
৩৩ বছরে তার জীবনের ওপর দিয়ে কত ট্রাজেডি বয়ে গেছে এবং কত যে দুঃখগাঁথা সয়ে গেছেন হিসেবের খাতায় সেটি হয়তো লেখাও নেই! হারিয়েছেন স্ত্রী-পুত্র-স্বজন! তিন তিনবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর লড়াইয়ে এসেও ব্যর্থ! কিন্তু দমে যাননি!
অবশেষে চতুর্থবারে এসে মার্কিন নাগরিক কথা রাখলো। প্রায় ৭৮ বছর বয়সে এসে বাইডেন পেলেন জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট স্বপ্নের দেখা! সুনির্দিষ্ট ব্যবধানে জিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ডেমোক্র্যাট দলীয় এই নেতা। আর সফর সঙ্গী কমলা হ্যারিস ইতিহাস গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। একই সাথে তিনি হলেন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
রেকর্ড সংখ্যক আগাম ভোট পড়ায় নির্বাচনের লড়াই আদালতে গড়ানোর শঙ্কা নিয়েই এবার ৩ নভেম্বর শুরু হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। শেষ জনমত জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ১০পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে থেকে নির্বাচন শুরু করেন জো বাইডেন। নির্বাচন পূর্ব জনমত জরিপেও তিনি এগিয়ে ছিলেন।
৩ নভেম্বর প্রথম প্রহরের ভোট অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ছোট্ট শহর ডিক্সভিলে নচেতে। সেখানকার সর্বমোট পাঁচটি ভোটের সবই পড়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের পক্ষে। ফলে সবগুলো ইলেকটোরাল (৪) ভোট তার পক্ষে যায়।
এর মধ্যদিয়ে বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এর ফল ঘোষণাকারী প্রথম এলাকা হলো এটি। সেখান থেকেই জয় শুরু বাইডেনের। এরপর কানাডার সীমান্তবর্তী অঙ্গরাজ্য ভার্মন্টের ৩টি ইলেকটোরাল ভোটও জিতে নেন তিনি।
এভাবে ক্যালিফোর্নিয়া-৫৫, কলারোডো-৯, কানেকটিকাট-৭, ডেল্যাওয়ার-৩, ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া-৩, হাওয়াই-৪, ইলিনিয়জ-২০, ম্যারিল্যান্ড-১০,ম্যাসাচুয়েটস-১১, নিউ জার্সি-১৪, নিউ মেক্সিকো-৫, নিউইয়র্ক-২৯, অরিগ্যান-৭, রুডস আইল্যান্ড-৪, ভার্জিনিয়া-১৩, ওয়াশিংটন-১২, মেইন-৪ এ জয় লাভ করেন জো বাইডেন।
এরপরই কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি বাইডেন! সামনে আসে ব্যাটলগ্রাউন্ড বা সুইং স্টেট হিসেবে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলো। যেমন-অ্যারিজোনা-১১, ফ্লোরিডা-২৯, জর্জিয়া-১৬, লউয়া-৬, মিশিগান-১৬, মিনেসোটা-১০, নেভাডা-৬, নর্থ ক্যারিলোনা-১৫, ওহাইও-১৮, পেনসেলভেনিয়া ও উইসকনসিন-১০।
প্রথম দিকে গণনায় দেখা যায়, ব্যাটলগ্রাউন্ডে ট্রাম্প এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ডাকযোগে ভোট গণনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। ট্রাম্পকে একের পর একে পেছনে ফেলতে থাকেন বাইডেন। এমন সময় এক ভাষণে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে ভোট গণনা বন্ধের আহ্বান জানায় ট্রাম্প। সেই সাথে ভোট গণনা বন্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ারও হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট! ইতিহাসকে হাস্যকর প্রমাণ করতে, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ভোট কারচুপির অভিযোগ আনেন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে!
কিন্তু ট্রাম্পের কথায় মার্কিন নির্বাচনের ভোট গণনা বন্ধ থাকেনি। নির্বাচনী কর্মকর্তারা স্পষ্ট বলে দেন, ভোট কারচুপির কোনো প্রমাণ মেলেনি! ফলে সমান তালে চলতে থাকে ভোট গণনা। কারণ ১০ কোটির বেশি ডাকযোগের ভোট গণনা সম্পন্ন করা না হলে আদতে নির্বাচনের ফলই হয় না! এবার নির্বাচনে ভোট দিয়েছে ১৬ কোটি মার্কিন নাগরিক!
ডাকযোগের ভোটে দেখা যায়, মিশিগান-১৬, মিনেসোটা-১০, উইসকনসিন-১০ এ এগিয়ে যান জো বাইডেন। ২৫৩ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে ট্রাম্পের চেয়ে ৫০ ভোটে এগিয়ে থাকেন তিনি। তখন ট্রাম্পের ভোট ২১৪।
সর্বশেষ অ্যারিজোনা-১১, জর্জিয়া-১৬, নর্থ ক্যারিলোনা-১৫, নেভাডা-৬ ও পেনসেলভেনিয়া-২০ নিয়ে শুরু হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এর মধ্যে বাইডেনের শুধু পেনসেলভেনিয়া অথবা অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারিলোনা ও নেভাডা থেকে দুটি জিতলেই হয়ে যায়। আর ট্রাম্পের জন্য সকল সমীকরণ কঠিন হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট হতে গেলে তাকে এই পাঁচটি থেকে পেনসেলভেনিয়া সহ চারটি অঙ্গরাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট জিততে হবে। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য দিল্লি বহুদূর হয়ে পড়ে!
নানান উৎকণ্ঠা ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝেই অবশেষে নেভাডা-৬ ও পেন্সিলভেনিয়া-২০ জয়ের হোয়াইট হাউসের দিকে আরও বেশি এগিয়ে যান বাইডেন। ২৫৩ থেকে হয়ে যায় ২৭৯ ইলেকটোরাল ভোট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান জো বাইডেন।
মূলত ভোট গণনা বিলম্বিত হওয়ার ফলে চুড়ান্ত ফলাফল জানতে লেগে যায় চারদিনের বেশি সময়। করোনা মহামারীর কারণে এই বছর ডাকযোগে যুক্তরাষ্ট্রের শত বছরের ইতিহাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, ডাকযোগের অধিকাংশ ভোটই ডেমোক্র্যাট দলীয় জো বাইডেনের পক্ষে পড়েছে। কেননা, তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করেছেন যেন, মহামারীর সময় জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে আগে আগে ভোট দিয়ে দেন সমর্থকরা। নির্বাচনের ফলাফলেও সেই একই ধারায় এগিয়ে যান জো বাইডেন।
গতরাতে এক ভাষণে সবাইকে সাথে নিয়ে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট।
জো বাইডেন বলেন, ‘লাল বা নীল রাজ্য নয়, আমার নজরে রয়েছে শুধুমাত্র আমেরিকা।’