পর পর দুটি বড় জঙ্গি হামলার পর দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে দেশে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কীভাবে জঙ্গিবাদী তৎপরতা ঠেকানো যায়, দেশের যুবদের জঙ্গিবাদী আদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, উদ্যোগ আয়োজন। জঙ্গি তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে নানাজন নানা পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। সরকারও নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করছে।
ভারত, আমেরিকাসহ বিভিন্ন শক্তিধর দেশ দেশের জঙ্গিবাদ ঠেকানোর ক্ষেত্রে পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। অনেকেই বলছেন, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক ইস্যু। একক কোনো দেশের পক্ষে এই তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক ইস্যু এটা যেমন ঠিক। আবার আমাদের দেশের তরুণরা জঙ্গি হয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলায় অংশগ্রহণ করছে-এটাও সত্য। আমাদের সবার আগে দেখেতে হবে, তরুণরা যেন কোনো মতেই জঙ্গি তৎপরতায় জড়াতে না পারে। জঙ্গিবাদ আশ্রয়-প্রশ্রয়-বিকশিত হতে পারে এমন কোনো কিছুই বরদাশত করা যাবে না। এ জন্য যা কিছু করার সবই করতে হবে।
আমরা জানি যে, জঙ্গিবাদী উত্থানের পেছনে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোই মূল ভূমিকা পালন করেছে। আমেরিকা, জার্মানি-ব্রিটেন-ফ্রান্স এবং সৌদি আরব হচ্ছে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীদের উৎসভূমি। অস্ত্র ও অর্থ জোগানদার। কী করে ভুলব আমেরিকার ইরাক যুদ্ধ? আল কায়দা, ওসামা বিন লাদেনের সৃষ্টিকর্তা কে? রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য আল কায়দা, তালেবান তৈরি করেছিল কে?
লাদেনের মৃত্যুর পরে জল রীতিমতো ঘোলা। আল কায়দার একাংশ বিভক্ত আল কায়দার কট্টরবাদীরা ইরাকের মসুল এবং তিকরিতে জর্ডনের (বংশোদ্ভূত) আবু মুসাব আল জারকাউইর নেতৃত্বে গড়ে আইএস। জারকাউই মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হলেও তার সাগরেদরা আরও ঐক্যবদ্ধ হন। গঠন করেন দায়েস (আইসিস)৷ এই আইসিস খিলাফত তৈরি করতে মরিয়া। নামকরণ করা হয় ‘ইল দাওলা’ মানে, দ্য স্টেট৷ খিলাফত (দ্য স্টেট)-এর খলিফা হন (ঘোষণা করেন নিজেকে) আবু বকর আল বাগদাদি। এই হত্যাকারী মার্কিনবাহিনীর কব্জায় বন্দি ছিলেন, কেন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, পেন্টাগন থেকে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। সেই সময় আমেরিকার প্রেম কেন টগবগ করেছিল বাগদাদিকে নিয়ে, এখনও খোলসা হয়নি।
সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে হত্যার পরে বাথ পার্টির অনেকেই আইসিস-এ যোগ দেন। কারণও আছে বাথ পার্টির অধিকাংশই সুন্নি। সুন্নিরা মাইনরিটিতে পরিণত হয় অচিরেই। সিরিয়ায় শিয়া ও সুন্নি যুদ্ধে সুন্নিরা আসাদের বিরোধী। বাগদাদি সুযোগ নেন। সৌদি আরব শুরুতে মদত জোগায়। ভাবেনি বুমেরাং হবে। ঘটনা এত বিস্তারিত, অল্প কথায় এ কেচ্ছা শেষ করা কঠিন।
মূল কথা হলো, আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা অনেক ধর্মবাদীকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে আত্মঘাতী হতেও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। প্যারিসে যে নারকীয় হামলা হয়, এর প্রধান ভূমিকায় ছিল সহোদর দুই ভাই। আমাদের দেশে গুলশানে বা শোলাকিয়ায় যে হামলা হয়েছে, সেখানেও অংশ নিয়েছে আত্মঘাতী হামলাকারীরা।
প্রশ্ন হলো যারা আত্মঘাতী হতে চায়, নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে, তাদের দমন করার হাতিয়ার কী হতে পারে? পশ্চিমা বিশ্ব এই সমস্যার সমাধান করবে কোন অস্ত্রবলে? আমরাই বা তাদের ঠেকাব কীভাবে? যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে রাইফেল, পিস্তল বা বোমা মেরে অন্যকে মারে এবং নিজেকে হত্যা করতে প্রস্তুত, তাদের ভয় পাওয়ানো যাবে কি? আজ আইসিস বা আইএসকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। কাল কোনো গোপন গহ্বর থেকে আর একদল আবাউদ আবদেস সালাম, নিবরাস ইসলাম, মুবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ, আবির, উজ্জ্বল বেরিয়ে আসবে, রেস্তোরাঁয় কিংবা অন্য কোনো সমাবেশে আসা একদল নিরপরাধ মানুষের ওপর বিছিয়ে দেবে বুলেটের চাদর! এই সন্ত্রাসী তৎরতা ঠোকানো যাবে কীভাবে?
কেন যুবরা আত্মঘাতী হচ্ছে? তাদের বোঝানো হচ্ছে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে একটি ‘স্বর্গরাজ্য’ গড়ে তোলা সম্ভব এবং এটা করা তাদের দায়িত্বের অংশ। তাদের বোঝানো হচ্ছে এক মধ্যযুগীয় ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসনেই সব সমস্যার সমাধান। গোটা পৃথিবীতে সেই স্বর্গরাজ্য গঠনের প্রথম ধাপ মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভণ্ড (ISIL)-কে প্রতিষ্ঠা করা এবং রক্ষা করা (লেভণ্ড ভূমধ্যসাগর এবং টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড তাতে আছে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, প্যালেস্তাইন, ইজরায়েল এবং সাইপ্রাস দ্বীপ)।
এবং এই ‘স্বর্গরাজ্য’ গঠনের পথে ন্যায়-অন্যায়, মানবিকতা-অমানবিকতার কোনো ফারাক করা যাবে না। গান শুনতে বসা মানুষকে মারা যাবে, বন্দীদের শিরচ্ছেদ করা যাবে, লোক আটকে মুক্তিপণ নেওয়া যাবে, বেআইনি বাজারে তেল বিক্রি করা যাবে— ‘স্বর্গরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার পথে পাপ-পুণ্যের কোনো ফারাক করা যাবে না। এটা যুবদের মাথায় ধর্মীয় ভাবাগের মিশ্রণে কায়দায় বোঝানো হচ্ছে যে তারা এটা বিশ্বাস করছে। এই বিশ্বাসই তাদেরকে ঠাণ্ডামাথার খুনিতে পরিণত করছে।
কেউ কোনো দিন দাবি করবে না ইরাকের সাদ্দাম, লিবিয়ার গাদ্দাফি বা সিরিয়ার আসাদ এরা খুব আদর্শ শাসক। কিন্তু তাদের শাসনামলে বর্তমান ধারার ‘সন্ত্রাসবাদের’ কোনো চিহ্ন ছিল না। ‘গণতন্ত্রের চাম্পিয়ন’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশ দখল করার পর এরা মাথা চাড়া দিল। আইসিস উৎপত্তি হলো ইরাকের আলকায়দা থেকে। আফগানিস্তান বা ইরাক প্রতি ক্ষেত্রেই আলকায়দার জন্মের পেছনে আমেরিকার ভূমিকা আছে এটা জানতে ডিএনএ টেস্ট করতে হয় না, রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রাথমিক জ্ঞানই যথেষ্ট।
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে আইসিসের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি এখন লিবিয়া। গাদ্দাফির আমলে কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লিবিয়ায় ছিল না। মার্কিনী এবং ফরাসিদেরও প্রকাশ্য মদতে লিবিয়ার বিদ্রোহীদের তৈরি করা হলো। কালভার্টে লুকিয়ে ছিলেন গাদ্দাফি। তাকে টেনে হিঁচড়ে বার করে কুকুর বেড়ালের মতো গুলি করে মারা হয়েছে। মার্কিন আশীর্বাদ নিয়ে যারা গাদ্দাফিকে মেরেছিল তারাই এখন লিবিয়ার আইসিস।
আইসিস পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কেবল না, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। সিএনএন-এর হিসেব মতে, আইসিস-এর প্রতিদিনের আয় ১ মিলিয়ন থেকে ২ মিলিয়ন ডলার, আর গার্ডিয়ানের হিসেবে আইসিস-এর মোট বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ ২বিলিয়ন ডলার!
কোথা থেকে এত টাকা আসে? এর বড় উৎস সৌদি আরব, কুয়েতের ধনকুবেরদের দেওয়া ব্যক্তিগত আর্থিক অনুদান। কে বন্ধ করবে? বারাক ওবামা? ওয়াশিংটন পোস্টের মতো কাগজ লিখছে, সৌদি আরবকে চটিয়ে আইসিসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা করা আমেরিকার পক্ষে অসম্ভব। তাহলে যা হচ্ছে যা চলছে, সবই কী খেলা? আইওয়াস?
তবে কথা একটাই, আইসিস বা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই হবে, যেকোনো মূল্যে ওদের উত্থান ও বিস্তার ঠেকাতে হবে। ঠেকাতে হবে ভবিষ্যতের ‘আত্মঘাতী’ নিবরাস, মুবাশ্বের, রোহান, আবির, উজ্জ্বলদের। সেটা ঠেকানোর একমাত্র হাতিয়ার সুস্থ বিশ্বাস। মতাদর্শিক লড়াই। আগামী দিনের আত্মঘাতী যুবদের বোঝাতে হবে অন্য ধর্মের অসহায় মানুষকে মারাটা কখনও কোনো ‘ঈশ্বরের রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠার শর্ত হতে পারে না। কোনো ‘ঈশ্বরের রাজত্ব, কোনো একটা ধর্ম বা একটা গোষ্ঠীর রাজত্ব নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)