ইউরোপিয়ান ফুটবলে অভিজাত ক্লাবগুলোকে মাপা হয় এক মানদন্ডে। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ীদের অবস্থান থাকে কুলীন শ্রেণীতে। এরা অভিজাত। আর যারা ইউরোপ সেরার স্বাদ পায়নি তারা অনেকটা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ, ‘জাতহীন’। যতই অর্থ ঢেলে দল সাজানো হোক না কেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা না পর্যন্ত কোনোভাবেই জাতে ওঠা যাচ্ছে না। প্রতি মৌসুমে তাই জাতে ওঠার জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ ম্যানচেস্টার সিটি, পিএসজির।
অভিজাতদেরও আবার শ্রেণী ভাগ আছে। সর্বোচ্চ ১৩বার ইউরোপ সেরা রিয়াল মাদ্রিদ সবার ওপরে। এরমধ্যে তিন শিরোপা আবার টানা জেতা। আগের পাঁচ মৌসুমে চারবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতায় সদ্যশেষ মৌসুমের একটাও শিরোপা জিততে না পারার ব্যর্থতা অনেকটাই নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়েছেন রিয়াল সমর্থকরা। সে কারণেই পদটাও বেঁচে গেছে সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এমনই গুণ, রিয়াল সমর্থকরা অনেকটা ভুলে গেছেন যে, সবশেষে সাত মৌসুমে তাদের লিগ শিরোপা জেতা হয়েছে কেবলই একবার!
রিয়ালের ঠিক উল্টো অবস্থানে তাদেরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা। অভিজাতদের কাতারে থাকলেও একটা সময় তারা এককোণে পড়েছিল। রোনালদিনহোর পরপর লিওনেল মেসির আবির্ভাবে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সময় সময় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে উঠে গেছে বড়দের কাতারে। তারা এখন ইউরোপের অন্যতম সফল ক্লাব।
কিন্তু মুখে বড় বললে তো আর মন ভরে না, চাই সাফল্যও। শেষ সাত মৌসুমে ছয়বার জেতার পর আর তাই লিগের প্রতি অরুচি ধরে গেছে কাতালোনিয়ানদের। পাঁচবারের ইউরোপ সেরা, এমন কথাতেও মন ভরে না। অন্যপ্রান্তে গত তিন মৌসুমে রিয়াল সমর্থকদের উচ্ছ্বাসটা বেশ জ্বালা-পোড়া করেছে। তাই এবার খুব করেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগটা চাচ্ছিলেন বার্সা সমর্থকেরা। তাদের ইচ্ছা পূরণের খুব কাছেও চলে গিয়েছিল মেসি-সুয়াজেদের দল।
কিন্তু হায়, বিধিবাম! প্রথম লেগে ৩-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরও লিভারপুলের কাছে ৪-০ ব্যবধানে হারে। অর্থাৎ সেমিফাইনাল থেকেই খালি হাতে বিদায়। কেবল মাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাতে না পারার ব্যর্থতায় টানা দুই মৌসুমে ডাবল জয়ী কোচ আর্নেস্টো ভালভার্দের বিদায় চায় বার্সা সমর্থকেরা।
ভালভার্দে নিজ থেকে যাবেন নাকি তাকে বিদায় করা হবে সেটা জানা যাবে খুব শীঘ্রই। ইউরোপিয়ান বাজারে গুঞ্জন, তাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিয়ে জুভেন্টাসের সদ্য বিদায়ী কোচ ম্যার্সিমিলিয়ানো অ্যাল্লেগ্রিকে আনতে চায় বার্সা।বরখাস্ত হওয়ার আগে নিজ থেকেই বের হয়ে আসাকে সম্মানের মনে করেছেন এই ইতালিয়ান ভদ্রলোক। কারণ একটাই, জুভদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারেননি তিনিও!
আসলেই জুভেন্টাসের যা দশা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা ছাড়া আর কোনো গতিও নেই তাদের সামনে। অনেকটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই টানা অষ্টমবারের মত লিগ জিতেছে তুরিনের বুড়িরা। লিগ শিরোপাটা এখন তাই সৎ ভাইয়ের মত! চাই নতুন চ্যালেঞ্জ জয়। সেই চ্যালেঞ্জ জেতার জন্য ১০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকেও দলে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কিসের কী? কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই মৃত্যু আরেকবার ইউরোপ সেরা হওয়ার স্বপ্নের!
বার্সা-জুভেন্টাসের মত শেষ কয়েক মৌসুমে ঘরের বাঘ হয়ে আছে পাঁচবারের ইউরোপ সেরা বায়ার্ন মিউনিখও। সবশেষ ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পর থেকে ক্লাবটি যেন তাদের নখের ধাঁর হারিয়ে বসে আছে। বুন্দেসলিগা কাঁপিয়ে বেড়ালেও কার্যত বায়ার্ন এখন নখদন্তহীন বাঘ।
তবে এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। প্রজন্মের একটা পালা-বদলের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে বাভারিয়ানরা। যাদের হাত ধরে সবশেষবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল ক্লাবটি, তাদের বেশিরভাগই হয় অবসর নিয়েছেন, নয়তো নেয়ার পথে। যেমন এ মৌসুম শেষেই বিদায় বলে দিয়েছেন দুই কিংবদন্তি আরিয়ান রোবেন ও ফ্রাঙ্ক রিবেরি। সামনের মৌসুমে হয়তো অনেকেই ক্লাব ছাড়বেন। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে তরুণ আরেকটি প্রজন্ম গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন কোচ নিকো কোভাচ।
ম্যানসিটি আর পিএসজির ব্যাপারটা প্রায় একইরকম। দুই দলই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে টাকা ঢালছে। আর টাকা ঢালতে গিয়ে দলবদলের পন্থা কী বৈধ হচ্ছে, নাকি অবৈধ সেটা বিন্দুমাত্র কেয়ারও করছে না ক্লাব দুটি। আর যেকারণে দলবদলের বাজার গরম করার দায়ে উয়েফার শাস্তিও ধেয়ে দুই ক্লাবের দিকে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার জন্য কী করছে না ম্যানসিটি-পিএসজি! যখন যে পজিশনেই খেলোয়াড় লাগছে দু-হাতে টাকা ঢেলে কিনে আনছে। দুই দলের আক্রমণভাগ অন্যতম সেরা। পিএসজিতে আছেন নেইমার, এমবাপে, কাভানিদের মত বিশ্বমানের ফরোয়ার্ড। ম্যানসিটিতে আছেন কেভিন ডে ব্রুইন, সার্জিও আগুয়েরো, রাহিম স্টার্লিংরা।
টানা দুই মৌসুমে লিগ জিতেছে ম্যানসিটি-পিএসজি। লক্ষ্য তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। কিন্তু এ লড়াইয়ে এলেই যেন পথ হারায় তারা। টানা তৃতীয়বারের মত দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায়ের রাস্তা মেপেছে পিএসজি। ম্যানসিটিও কূল পাচ্ছে না। কোয়ার্টার নইলে সেমিফাইনালে গিয়ে আটকে যাচ্ছে তরী। তারকা কোচ পেপ গার্দিওলার কারিশমায় মরচে পড়ে যাচ্ছে। কারণ সব সৌভাগ্য যে তিনি বার্সাকে ঢেলে এসেছেন!