বরিশাল শব্দটি মনে আসলেই সবার আগে মনে পড়ে জীবনানন্দের কথা। যতোবার বরিশালে গিয়েছি, মাথার মধ্যে অবিরত ঘুরপাক করেছে জীবনানন্দের বাড়ির কথা। যে মাটিতে জীবনের ৩০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে নীরবে প্রস্থান করেছেন আমাদের জীবন কবি সেই মাটি ছুঁয়ে দেখার সাধ বহুদিনের। কিন্তু যাই যাই করে আর কোনভাবেই যাওয়া হয় না।
অবশেষে শুধুমাত্র জীবনবাবুর নেশায় কোনো এক বৃহস্পতিবার রাতে চাঁদের আলোয় অভিযাত্রীর কয়েকজন মিলে ছুটে গেলাম সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। উঠে পরলাম সুন্দরবন-১১ লঞ্চে। সুন্দরবন-১১ ছুটছে বরিশাল অভিমুখে, আর চাঁদের আলো মোহময় করে তুলছে আমাদের জীবনানন্দকে।
ভোরবেলা বরিশালে পৌঁছে আরো কয়েকটা জায়গা ঘুরে বিকেলে স্নিগ্ধ আলোয় আমরা রওনা করলাম বরিশাল সদরের পশ্চিম বগুড়া রোডের দিকে।
ছুটতে ছুটতে চলন্ত অটো থেকেই হঠাৎ চোখে ভাসলো ‘ধানসিড়ি’ লেখা ফলক। আরে থামান থামান। ঐ তো ধানসিড়ি। আমাদের জীবনানন্দের বাড়ি। শরীরের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত শিহরণ। এখন পর্যন্ত এই বরিশালে বেশ কয়েকবার আসা হয়েছে। কিন্তু ছুঁয়ে দেখা হয়নি জীবনকবির এই স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু জীবনানন্দের বাড়িটি কোথায়? না কোনো বাড়ি নেই এখানে। প্রিয় কবির স্মৃতি হিসেবে আছে ধানসিড়ি নামের বাড়ির সেই নামফলক। আর একটি দেয়াল।
একটু সামনে এগুতেই মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। নামফলকের নিচেই ঝুলছে টু লেট। কি ভাড়া হবে? ধানসিড়ি? কবির পৈত্রিক বাড়ির জায়গায় যে নতুন বাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেটি? মনটা আরো বিষন্ন হয়ে গেল ধানসিড়ির ফটকের নিচেই স্তুপ করে রাখা নির্মাণসামগ্রী দেখে। ইট, বালু, খোয়া দিয়ে ময়লার স্তুপ বানিয়ে রেখেছে ধানসিড়ির প্রবেশপথ।
দলের একজন সদস্য জানালেন এই বাড়িটিতে আগে জীবনানন্দের পিসি সম্পর্কের এক ভদ্রমহিলা থাকতেন। জীবন কবির খোঁজে কেউ আসলে তিনি তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতেন। কিন্তু তিনি মনে হয় এখন থাকেন না বাড়িটিতে। করোনার কারণে বাড়ির দরজায় নক করারও সাহস হলোনা আমাদের। অন্যদিকে দরজায় লেখাও আছে কেউ যেন বিরক্ত না করে। কিছুক্ষণ সময় সেখানে দাড়িয়ে থেকে আবারো ধানসিড়ি ফলকের কাছে গেলাম। বুকটা হুঁহুঁ করে উঠল।
বরিশালের এ বাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে কবির ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘বাড়ির ভেতর ঝোপের মধ্যে কোথায় আনারসের গায়ে হলুদ ঝোপ এসেছে, কাঁঠাল কত বড় হয়েছে, কত আম ধরেছে, সবকিছুই থাকত কবির নখদর্পণে। এসব দেখতে তিনি কখনো ভুল করতেন না।’
আবার যদি প্রিয় কবি কখনো মানুষ না হয়ে শঙ্খচিল বা শালিখের বেশে ফিরে আসেন এই পশ্চিম বগুড়া রোডে, কি দেখবেন তিনি? এত অবহেলা, ময়লার ভাগার এসব দেখে কি ব্যথা পাবেন? নাকি নিয়তি হিসেবেই মেনে নেবেন? জীবনকালে যিনি পদে পদে অবহেলার শিকার হয়েছেন, মৃত্যুর পর যার কবিতা এত প্রশংসিত হয়েছে চারদিকে, স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি হিসেবে, সেই রূপসী বাংলার কবি ফিরে আসলে কি ভাববেন, সবই লোক দেখানো?
বাংলার বুকে জীবনানন্দের শেষ চিহ্নটুকু আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এই দৃশ্য দেখে শঙ্খচিল বা শালিখের বেশ ধারণ করা কবি কি ব্যঙ্গ করছেন না? হয়তো করছেন। হয়তো…
এসব ভাবতে ভাবতে চোখে পড়ল ধানসিড়ির পাশেই একটি দোতলা বিল্ডিং। নাম জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পাঠাগার। খুব সাধ হল পাঠাগারটি ঘুরে দেখার। কিন্তু শুক্রবার বলে বন্ধ ছিল সেটি।