চট করে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারি না আমি। হুট করে ভাইও ডাকতে পারি না। চ্যানেল আইয়ে যোগ দিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর ওই অফিসের ৫ তলায় খুব অসহায় দিন কাটছিলো আমার। মহল্লার মহাব্যস্ত ছেলেটা হঠাৎই যেন বিষণ্ন হয়ে পড়ছিলাম। একে তো কালচারাল রিপোর্টার, তার মধ্যে বয়সও কম। কারো সঙ্গেই যেন অ্যাডজাস্ট হচ্ছিলো না। এক দুপুরে খাওয়া শেষে এঁটো হাতে চশমার ফ্রেমটা নাচিয়ে একজন বললেন, এই আপনি খেয়েছেন?
ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে দেখি আমার সামনে স্বয়ং মাহবুব মতিন। ইটিভি’র বাঘা বাঘা জনপ্রিয় রিপোর্টারদের ঘাড়ে যে দু একজন চ্যানেল আই’র রিপোর্টার নিঃশ্বাস ফেলেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বললাম, জ্বি আমি খেয়েই এসেছি বাসা থেকে। বললেন, তাহলে তো আরো ভালো, চলেন আমেরিকায় যাই। না বুঝেই উনার পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। নিয়ে গেলেন অফিসের নিচে আমেরিকান ফাস্টফুডে। কফি আমার বিস্বাদ লাগে। বলতে পারলাম না । চরম অস্বস্তি নিয়ে চুমুক দিলাম।
এরপর আর কোন চুমুকেই অস্বস্তি লাগেনি মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে। একদিন অ্যাসাইমেন্ট শেষে অফিসে এসে কথার কথা বলেছিলাম, শালার সারা জীবন ফাইভস্টারে ফ্রি খেলাম। কোনদিন কি কিনে খেতে পারবো না? সেই দিন, হুম, আমার এখনো মনে আছে মাসের শেষ দিন ছিলো। সেই সন্ধ্যাতেই মাহবুব ভাই আমাকে নিয়ে তৎকালীন শেরাটন হোটেলের লবিতে বসলেন। আমরা দুজন সেখানে কিছুটা চিল্ড হলাম।
হোটেল থেকে বেরিয়ে মাহবুব ভাই বললেন, দেখেন রাজীব এমন একটা দিন আসবে আমরা এখানে নিয়মিত আসবো। আমার ‘ছোটরাই’টাকে (মাহবুব ভাইয়ের হাতে গড়া শিশু সংগঠন) আগে একটু দাঁড় করিয়ে নেই। শুধু ‘ছোটরাই’ না– এমন অনেক আইডিয়া গিজগিজ করতো মাহবুব ভাইয়ের মাথায়। ফেসবুকের মতো আরো একটি যোগাযোগের মাধ্যম হবে। তবে এটা শুধু সাংবাদিকদের। অফিসের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সংবাদ সারা বিশ্বে চাপা পড়ে যায়। সেই সব খবর শেয়ার হবে ওই মাধ্যমে। অর্জিত অর্থে সাংবাদিকদের বৃদ্ধ বয়সে সহায়তা করা হবে।
তখন উনার অনেক কথায় আমার মাথার ওপর দিয়ে যেতো। তবে উনার অস্থির স্বভাবে সুস্থির চিন্তা আমাকে স্বপ্ন দেখাতো। সব স্বপ্ন অবশ্য উনি আমাকে দেখতে দেননি। নিজে ইটিভিতে যোগ দেয়ার মতো ঝুঁকি নিলেও আমাকে নিতে দেননি। বলেছিলেন, রাজীব আপনার জন্য বাংলাদেশে বেস্ট চ্যানেল আই। আপনি সারাজীবন এখানেই থাকবেন। কারণ আপনি সংস্কৃতিমনা। এ ধরণের মানুষের জন্য চ্যানেল আই ভালো।
অল্প কিছুদিন পর আবার চ্যানেল আইয়ে ফিরে এসে বলেছিলেন, দেখেছেন আপনাকে না নিয়ে কি বিরাট লজ্জার হাত থেকে বাঁচালাম। বলেই হো হো করে হেসেছিলেন। হাসতেও পারতেন মানুষটা। মন ভালো নেই, তারপরও হেসে যাচ্ছেন ছেলে নতুন কি শিখলো সেই গল্প বলে। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম, ইশ! বাবা হলে আমিও কি মাহবুব ভাইয়ের মতো অনুভব করবো সন্তানের জন্য?
হ্যাঁ, এখন আমার সন্তানের জন্য আমার একইরকম অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু, মাহবুব ভাইয়ের এখন তার ছেলে ‘মৌনপ্রিয়’র জন্য কেমন লাগে জানি না। আমি মাহবুব ভাইয়ের মনের অনেক খবরই জানতাম। একই স্টাট্যাসের সাংবাদিকরা যখন ফ্ল্যাট-গাড়ি কিনে ফেলছেন, তিনি কেন পারছেন না– এর জবাব দিতে উনার কেমন লাগতো আমি জানতাম। আমি জানতাম ছোটরা পাশ কাটিয়ে বড় হয়ে গেলে বড়দের নিজেকে কতটা ছোট লাগতো। আমি এসবই জানতাম।
শুধু জানতাম না কেন উনি আমাকে এতো স্নেহ করেও আপনি সম্বোধন করতেন। উনি হয়তো জানতেন, একদিন আমি বা আমরা উনার চেয়ে বয়সে বড় হয়ে যাবো। মাহবুব ভাইয়ের বয়স আর বাড়বে না। বার্ধক্য খুব অপছন্দের ছিলো মাহবুব ভাইয়ের। তাই হয়তো প্রকৃতি তাকে বৃদ্ধ হতে দেয়নি।
মাহবুব ভাই প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসেন। বলেন, রাজীব যাবেন নাকি? আমি যেন কি বলতে চাই, ঠিক তখনই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। যেমন ভেঙেছে একজন সৎ নির্ভীক পরিশ্রমী ও স্বাধীনচেতা সংবাদকর্মীর অনেক অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্টের স্বপ্ন। যেমন ভেঙেছে শুধুই মৌনপ্রিয়কে নিয়ে বহু বছর বেঁচে থাকার একজন বাবার স্বপ্ন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)