রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের সওগাত নিয়ে মাহে রমজানের আগমন ঘটে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রমজান এমন মাস যার প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফেরাতের আর শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির। (ইবনে খুজাইমা: ১৮৮৭) মুল্লা আলী কারী র. বলেন, ‘যদি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে রহমত না আসতো, তবে কোনো বান্দাই রোজা, তারাবীহ, তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য ইবাদত করতে পারতো না। এজন্য নবী পাক সা. বলতেন, যদি আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়াত না করতেন, তবে আমরা দান-সাদকা করতাম না, নামাজ আদায় করতাম না। অর্থাৎ, ইবাদত করার সামর্থ্য পূরোটাই আল্লাহর রহমতে প্রদত্ত। আর রহমতের বারি বর্ষণে সিক্ত বান্দা ইবাদতের মাধ্যমে মাগফেরাত অর্জনে সক্ষম হয় এবং সফলতার পূর্ণতা আসে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের মাধ্যমে।’ (মিরকাত: ৪/১৩৬৯)
মাহে রমজানের শেষ দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন রমজানের বিদায়ের সূর বেজে ওঠে। এ সময় বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে নাজাত হাসিল করা খুব জরুরি। কেননা জাহান্নাম থেকে নাজাত হাসিল করে জান্নাত লাভ করাই মুমিন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ সময় ইবাদত বন্দেগি বাড়িয়ে দিতেন। মা আয়েশা রা. বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আগমন করতো, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন (অর্খাৎ ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতেন), নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারবর্গকেও রাতে জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারী: ১৮৮৪) আয়েশা রা. আরও বলেন, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে যে পরিমাণ ইবাদত বন্দেগি করতেন, তা অন্য সময় করতেন না।’ (মুসলিম: ২৮৪৫)
রমজানের শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারী: ২০২০) এ রাতের ফজিলত যাতে করে ছোটে না যায়, সেজন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। পূর্ববর্তী উম্মত হাজার বছর হায়াত পেত, শত শত বছর ইবাদত করত, এসমস্ত আলোচনা শুনে সাহাবায়ে কেরাম যখন নিজেদের কম হায়াতের চিন্তায় মগ্ন হলেন, আল্লাহ পাক প্রিয় নবীর উসিলাতে তাঁর প্রিয় উম্মতকে লাইলাতুল কদর উপহার দিলেন। নিজেই এর ফজিলত বর্ণনা করে কোরআন মাজিদে একটি সূরাই নাজিল করে দিলেন। নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকের একটি রাতকে নির্ধারিত করে লাইলাতুল কদর বলে দেননি; বরং শুধু এ দশকে বেজোড় রাতগুলোর কথা বলেছেন। তাই সকলের উচিত হবে এ দশকের পূরো সময় জোড়েই বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করা যাতে এ ফজিলত অর্জন করা সম্ভব হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে লাইলাতুল কদরে ঈমানের এবং সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করবে, তার জিন্দেগির সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারী: ১৭৬৮)
রমজানের শেষ দশকেই কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন।’ (সূরা বাকারা: ১৮৫) আল্লাহ পাক এ কোরআনকে লাওহে মাহফুজে রমজানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদরে নাজিল করেছেন। আর লাওহে মাহফুজ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ২৩ বছরে প্রয়োজনানুসারে ধিরে ধিরে নাজিল হয়েছিল। সেজন্য এ সময় বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করা কোরআন মাজিদের হক বা অধিকার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে ইয়া আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বাধা দিয়েছি, অতএব আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, ইয়া আল্লাহ! আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বাধা দিয়েছি, অতএব আমার সুপারিশ কবুল করুন। এরপর তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে। (মুসনাদে আহমদ: ৬৬২৬) অন্য হাদিসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোরআন মজিদের একটি আয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনলো, তার জন্য বর্ধনশীল সাওয়াব রয়েছে, আর যে তা তেলাওয়াত করলো, কিয়ামত দিবসে তা তার জন্য আলোকবর্তিক হবে। (মুসনাদে আহমদ: ৮৪৭৫)
এ দশকে ইতেকাফের মতো অশেষ ফজিলতপূর্ণ ইবাদত রয়েছে। আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার জিন্দেগিতে কোনো রমজানে শেষ দশকের ইতেকাফ পরিত্যাগ করেননি। লাইলাতুল কদর তালাশের নিশ্চিত পদ্ধতি হলো ইতেকাফ। সাহাবায়ে কেরাম আওলিয়ায়ে ইজাম সকলেই ইতেকাফ করেছেন। মনিবের সাথে বান্দার গভির সম্পর্ক স্থাপনের এ এক অনিন্দ্য সুন্দর মাধ্যম। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন সব কিছু ত্যাগ করে মহান প্রভুর একান্ত ইবাদতে লিপ্ত থাকার মহা সুযোগ ইতেকাফ। আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর ২০ দিন ইতেকাফ করেছিলেন।’ (বুখারী: ২৬০)
মাহে রমজানের শেষ দশকে সাদকাতুল ফিতর দেওয়া হয়ে থাকে। সিয়াম-সাধনাতে বান্দার দোষ-ত্রুটি হয়ে থাকলে এর মাধ্যমে তার কাফ্ফারা হয়ে যায়। তাছাড়া এতে গরিব-মিসকিনদের সাহায্যও করা হয়ে থাকে। নবি পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এটা (সাদকাতুল ফিতর) রোজার ভুল-ত্রুটিকে পবিত্রকারী এবং মিসকিনদের খাবার।’ (আবূ দাউদ: ১৬১১) এ আমলের মাধ্যমে আমাদের রোজাগুলো ত্রুটিমুক্ত করার সুযোগ থাকে।
নাজাতের এ শেষ দশকে তাই আমাদেরকে নতুন উদ্যমে ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে হবে। যে কয়টি দিন অবহেলায় কাটিয়ে দিয়েছি, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, বাকি দিনগুলো সিয়াম-কিয়ামের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল আমলের মাধ্যমে কাটাতে হবে। অন্যান্য নফল আমলের পাশাপাশি বিশেষ করে আমাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত কামনা করতে হবে। মা আয়েশা রা. নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি আমি জানতে পারি লাইলাতুল কদর কোনটি, তবে আমি কী আমল করব? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বলেছিলেন, তুমি এ দোয়া করো, ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (তিরমিজী: ৩৫১৩)
লেখক: মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ