বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৭০০তম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন লিওনেল মেসি। মাইলফলকের ম্যাচটা স্মরণীয়ও করে রাখলেন তিনি। এক গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও দুটি। ভেঙেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর রেকর্ডও। সব মিলিয়ে মেসির মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্সে ডুবেছে জার্মানদের হলুদ সাবমেরিন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলো নিশ্চিত করেছে কাতালানরা।
আগের ম্যাচগুলোতে অন্যদের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় এদিন শুরুর একাদশে অ্যান্থনিও গ্রিজম্যানকে রাখেননি কোচ আর্নেস্টো ভালভার্দে। ইনজুরি কাটিয়ে আগের ম্যাচেই দলে ফেরা লুইস সুয়ারেজকে রাখেন তিনি। মেসির সঙ্গে উরুগুয়ে তারকার রসায়নটা শুরু থেকেই চোখে পড়ে।
ঘরের মাঠে এদিন ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই প্রাধান্য বিস্তার করে খেলতে থাকে বার্সেলোনা। শুরুতে তেমন কোনো জোরাল আক্রমণ করতে পারেনি। তার উপর ম্যাচের প্রথম মিনিটেই পিছিয়ে পড়তে পারতো দলটি। ইভান রাকিটিচের ভুলে গোল খেতে বসেছিল স্বাগতিকরা। গোলরক্ষক মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেন ও ডিফেন্ডার ক্লেমেন্ট লেংলেটের দক্ষতায় সে যাত্রা বেঁচে যায় বার্সা। নিকো শুলজের শট প্রথম দফায় স্টেগেন ফেরানোর পর দ্বিতীয় দফায় আটকে দেন লেংলেট।
২৫ মিনিটের সময় ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়েন উসমান ডেম্বেলে। বদলি হয়ে গ্রিজম্যান মাঠে নামার পর আক্রমণে যেন প্রাণ পায় বার্সার। চার মিনিট পরই এগিয়ে যায় তারা। মেসির পাস থেকে অফসাইডের ফাঁদ ভেঙে বল ধরে দারুণ শটে জালে জড়ান সুয়ারেজ। ৩২ মিনিটেও ভালো সুযোগ পেয়েছিল বার্সা। গোল মুখে জটলা থেকে সুয়ারেজের শট ফিরিয়ে দেন এক ডিফেন্ডার। ফলে স্কোরলাইন আর বদল হয়নি।
পরের মিনিটে ম্যাট হ্যামেলসের ভুলে ব্যবধান বাড়ায় বার্সা। ফাঁকায় বল পেয়ে যান মেসি। সুয়ারেজের সঙ্গে বল দেয়া-নেয়া করে দারুণ এক কোণাকোণি শটে লক্ষ্যভেদ করেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। এটি তার ক্যারিয়ারের ৬১৩তম গোল। এই গোলের মাধ্যমে মেসি ভেঙে দেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একটি রেকর্ড। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৩৪তম প্রতিপক্ষে বিরুদ্ধে গোল করলেন এলএমটেন।
টুর্নামেন্টের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বেশি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গোল করার বিশ্বরেকর্ড। রোনালদো ও রাউল ৩৩টি প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছেন।
দ্বিতীয় ফুটবলার হিসাবে বার্সেলোনার হয়ে ৭০০ ম্যাচে মাঠে নামেন মেসি। তার আগে একমাত্র জাভি হার্নান্দেজ এমন কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন। জাভি মোট ৭৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন বার্সার হয়ে। সেই নিরিখে মেসি রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে। যদিও ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড ইতিমধ্যেই নিজের দখলে রেখেছেন মেসি। এই হিসেবে তার ধারে কাছে কেউ নেই। বরুসিয়ার বিরুদ্ধে গোলের পর বার্সার হয়ে মেসির অফিসিয়াল গোল সংখ্যা দাঁড়ায় ৬১৩। যদিও আনঅফিসিয়াল গোলগুলো মিলিয়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪৮।
মেসির মঞ্চে নতুন নজির গড়েন সুয়ারেজও। তিনি এই নিয়ে বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মোট ২৩টি গোল করেলন। এক্ষেত্রে সুয়ারেজ টপকে যান ব্রাজিলের সাবেক তারকা রিভালদোর ২২ গোল করার রেকর্ড। সব মিলিয়ে বার্সেলোনার হয়ে সুয়ারেজের গোল সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৭। অর্থাৎ মেসি ও সুয়ারেজ ক্লাবের হয়ে মিলিতভাবে মোট ৮০০ গোল করে ফেললেন। বার্সেলোনা এই নিয়ে টানা ১৩ বছর গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রি-কোয়ার্টারে পৌঁছাল।
৪২ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোল করার সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন মেসি। ফাঁকায় গোলরক্ষককে একা পেয়েও শট নিতে দেরি করে ফেললে সে সুযোগ নষ্ট হয়।
প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে সুয়ারেজের পাস থেকে ভালো সুযোগ ছিল গ্রিজম্যানের। কাজে লাগাতে পারেননি ফরাসি তারকা। বিরতির পর খেলার শুরু ৩০ সেকেণ্ডের মধ্যে একটি সহজ সুযোগ মিস করেন তিনি। মেসির পাস থেকে একেবারে ফাঁকায় বল পেয়েছিলেন গ্রিজু। তার শট দারুণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দেন ডর্টমুন্ড গোলকিপার রোমান বুয়ের্কি।
৬১ মিনিটে ব্যবধান কমানোর দারুণ সুযোগ মিস করে ডর্টমুন্ড। ফাঁকায় বল পেয়েও লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি মার্কো রিউস। অবিশ্বাস্য এক সেভ করেন টের স্টেগেন। পাঁচ মিনিট পর সার্জিও রবের্তোর ক্রস থেকে ভালো হেড নিয়েছিলেন মেসি। কিন্তু অল্পের জন্য লক্ষ্যে থাকেনি। পরের মিনিটেই গোল পায় বার্সা। পাল্টা আক্রমণ থেকে মেসির নিখুঁত পাসে লক্ষ্যভেদ করেন গ্রিজম্যান। বার্সার জার্সি গায়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এটাই তার প্রথম গোল।
৭৫ মিনিটে দুরূহ কোণ থেকে মেসির নেয়া ফ্রি-কিক বারপোস্টে লেগে ফিরে আসে। দুই মিনিট পর ব্যবধান কমায় ডর্টমুন্ড। হুলিয়ান ব্রান্ডের পাস দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দূরপাল্লার শটে লক্ষ্যভেদ করেন বদলি খেলোয়াড় জর্ডান সাঞ্চো। ৭৭ মিনিটে ব্যবধান আরও কমাতে পারতো তারা। আবারো অবিশ্বাস্য এক সেভ করেন স্টেগেন। সাঞ্চোর বুলেট শট ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেকিয়ে দেন তিনি। যদিও তিনি ফিস্ট করার পর বারপোস্টেও লেগেছিল বল। এরপর শেষদিকে দুই দলই গোল করার চেষ্টা চালিয়েছিল। আর কোনো গোল না হলেও জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে বার্সা।
পাঁচ ম্যাচ শেষে তিনটি জয় ও দুটি ড্রয়ে বার্সেলোনার সংগ্রহ ১১ পয়েন্ট। সমান সংখ্যক ম্যাচে ডর্টমুন্ড ৭ পয়েন্ট। ৭ পয়েন্ট ইন্টার মিলানেরও। গোল ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় দুইনম্বরে ইন্টার। এদিন স্লাভিয়া প্রাগকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারায় ইতালির ক্লাবটি। প্রাগের পকেটে মাত্র দুই পয়েন্ট।
ম্যাচ শেষে সুয়ারেজ বলেছেন, ‘আমাদের প্রথম টার্গেট ছিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। আর দ্বিতীয় টার্গেট ছিল আমাদের খেলায় উন্নতি করা। দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যেটা খেলেছি, তার জন্য আমাদের খুশিই হওয়া উচিত।’