Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

মার্কিনীরা জানতো অভ্যুত্থান ঘটাবে অন্য কেউ

ভারতীয়দের মতো মার্কিনীরাও দাবি করে যে, তারা হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ প্রধান আর এন কাওকে বঙ্গবন্ধু যে উত্তর দিয়েছিলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারকেও তিনি ঠিক সেই কথাই বলেছিলেন: নিজের মানুষ তাকে হত্যা করতে পারে না।

বাস্তব হচ্ছে পাকিস্তানিরা তার জন্য কবর খুঁড়ে রাখলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার নিজের দেশের মানুষই সপরিবার হত্যা করেছে। তবে, হত্যাকারীদের পরিচয় জানার পর মার্কিনীরাও বিস্মিত হয়েছিল। কারণ তারা যাদেরকে সম্ভাব্য হত্যাকারী মনে করছিল, তার বদলে হত্যাকারী ছিল অন্য একটি গ্রুপ।

আগে ধারণা করা সম্ভাব্য হত্যাকারীদের পরিচয় প্রকাশ না করলেও মার্কিন কূটনীতিকদের দাবি, হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল না। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কাছেও শেখ মুজিবুর রহমান ততোদিনে আর হুমকি বলে বিবেচিত কেউ ছিলেন না।

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আছে বলে একটি সাধারণ ধারণা থাকলেও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি এবং ঘটনাপ্রবাহের ‘কথ্য ইতিহাস’ ভিন্ন দাবি করে বলছে, তারা বরং শেখ মুজিবকে সতর্ক করেছিল। ১৯৭৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ ব্যুরোর বাংলাদেশ ডেস্কে কর্মরত স্টিফেন আইজেনব্রাউন মার্কিন এসোসিয়েশন ফর ডিপ্লোম্যাটিক স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেইনিং এর ‘কথ্য ইতিহাস’ প্রকল্পে যে সাক্ষাতকার দিয়েছেন তাতে তিনি দাবি করেছেন, মুজিবকে সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

‘… ক্যু ষড়যন্ত্র চলছিল, এমনকি মুজিবের জীবনও আশঙ্কার মধ্যে ছিল,’ সেসময়ের পরিস্থিতি বিশেষ করে রক্ষী বাহিনী গঠন এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে আইজেনব্রাউন বলেন, আমাদের দূতাবাসের কাছে বাংলাদেশীদের এমন ফিসফিসানি ছিল যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

তিনি বলেন: ওয়াশিংটনেও এমন খবর আসছিল। বুঝা যাচ্ছিল যে এটা কিছু অলস মানুষের গল্প-গুজব নয়। শেখ মুজিবের জীবন আসলেই বিপদের মুখে।

‘আমি মনে করতে পারি যে মুজিবকে তার জীবন নাশের আশঙ্কার বিষয়টা জানানো আমাদের নৈতিক দায়বোধের মধ্যে পড়ে কিনা সেসময় এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়: হ্যাঁ, এটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে,’ উল্লেখ করে আইজেনব্রাউন দাবি করেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেটা মুজিবকে জানাতে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার।

মার্কিনীরা জানতো অভ্যুত্থান ঘটাবে অন্য কেউ-বঙ্গবন্ধু
বামে: ডেভিস ইউজিন বোস্টার, ডানে: হেনরি কিসিঞ্জার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সাবেক নেভি কর্মকর্তা বোস্টার বাংলাদেশের পর নিকারাগুয়াতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি যেসব দায়িত্ব পালন করেন তার সব জায়গাতেই কোনো না কোনোভাবে সেসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপ সংশ্লিষ্ট ছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশও নানাভাবে সম্পর্কিত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। বাকশাল গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক ধরণের সমাজন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথেও ছিলেন।

প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত বোস্টারের ওই সাক্ষাতে কী ঘটেছিল?

আইজেনব্রাউন বলেন: রাষ্ট্রদূত যখন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যান সেটা সম্ভবত ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে কিংবা আগস্টের শুরুর ঘটনা। সম্ভবতঃ আমি আলোচনার বিষয়গুলোর খসড়া লিখে দিয়েছিলাম, তবে আমিই লিখেছিলাম কিনা সেটা আমি পুরোপুরি মনে করতে পারছি না। যাই হোক, বোস্টার যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন বলে ঠিক হয়েছিল সেটা এরকম যে আমরা সম্ভাব্য অনেক ক্যু ষড়যন্ত্র এবং বড় ধরণের সন্ত্রাসের হুমকির কথা জানতে পেরেছি। বোস্টার নামগুলো উল্রেখ করেননি। কিন্তু, মূল যে বিষয় সেটা হলো রাষ্ট্রদূত তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

‘যতোদূর মনে করতি পারি, মুজিব বিষয়টাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন: উদ্বিগ্ন হয়ো না। আমি আমার মানুষকে চিনি, তারা আমাকে ভালোবাসে এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে।

শেষ পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বাংলাদেশে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটে সেই দিনটি ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ ব্যুরোর বাংলাদেশ ডেস্কে আইজেনব্রাউনের শেষ কর্মদিবস।

ওই দিনটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: সেদিন ছিল শুক্রবার, আমার শুধু সবাইকে ‘গুড বাই’ জানানোর কথা। আগেরদিনই বাংলাদেশ ডেস্কের নতুন অফিসার অ্যান গ্রিফিনের কাছে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। পরের সোমবার থেকে ফরেন সার্ভিস ইন্সটিটিউটে আমার বাংলা ভাষা শেখার কথা (আইজেনব্রাউনের পরবর্তী মিশন ছিল ঢাকায়)।

‘সুতরাং, সেদিন অফিসে এসে আমার শুধু হই-হুল্লোড়ে বিদায় নেওয়ার কথা। কিন্তু, পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। কারণ কয়েক ঘণ্টা আগে পরিবারের সদস্যদেরসহ শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন।’

আইজেনব্রাউন পরে বাংলা ভাষা শিখে ১৯৭৬ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আটাত্তর থেকে ৮১ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের লাহোরে কনসুলার অফিসার এবং ৮১ থেকে ৮৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্ডিয়া ডেস্ক অফিসার ছিলেন। পরবর্তী ১৩ বছর আফ্রিকা এবং আফ্রিকা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৬ সালে আবার তিনি ঢাকায় এসেছিলেন পলিটিক্যাল/ইকনোমিক কাউন্সিলর হিসেবে। ঢাকায় তার দ্বিতীয় মেয়াদে অবস্থানের সময়ই প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ২১ বছর পর আবারও ক্ষমতায় আসে তার দল আওয়ামী লীগ।

সেই আইজেনব্রাউন ৭৫’র ১৫ আগস্ট তার দপ্তরে গিয়ে জানতে পারেন তারা যেটা আশঙ্কা করছিলেন সেটাই হয়েছে, সপরিবার নিহত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব। ওই হত্যাকাণ্ডকে তিনি ১৯১৮ সালে রাশিয়ার জারের সপরিবার নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেন।

‘আমার যতোদূর মনে পড়ে, যে সেনা কর্মকর্তারা মুজিবকে হত্যা করে– এরকম না যে ক্যু পরিকল্পনাকারী হিসেবে কয়েকদিন ধরে আমরা যাদের নাম শুনছিলাম তাদের মধ্যে সেই খুনিরা ছিল। বাংলাদেশিদের কাছে হত্যাকাণ্ডটি যেমন বিস্ময়ের বিষয় ছিল, আমেরিকানদের কাছেও অনেকটা তাই।’

মার্কিনীরা জানতো অভ্যুত্থান ঘটাবে অন্য কেউ-বঙ্গবন্ধু
স্টিফেন আইজেনব্রাউন

এ বিস্ময়ের দাবি করে আইজেনব্রাউন বলেন: বিষয়টি এ কারণে উল্লেখ করছি যে (বিদেশে থাকার কারণে) ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা (যিনি ঢাকায় আমার দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষমতায় আসেন) তার বিশ্বাস যে, মুজিব হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে আমেরিকানরা আগে থেকেই জানতো এবং এটা থামাতে তারা (আমেরিকানরা) কিছুই করেনি; বরং এর পেছনে আমেরিকানদের একটা হাত আছে।

‘১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ডেস্কে দায়িত্ব পালন থেকে আমি জানি যে, যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত যাদের দ্বারা অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছিল তাদের দ্বারা সেটা সংঘটিত হওয়া আমেরিকানদের কাছে ছিল বিস্ময়ের বিষয়। বিশ্বাস করুন, ওইদিন বাংলাদেশ ডেস্কে এটা ছিল এক বিশাল ধাক্কা,’ এভাবে যাদের দ্বারা অভ্যুত্থান ঘটার আশঙ্কা ছিল তার বাইরে অন্যদের দ্বারা অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ায় তাদের বিস্ময়ের বিষয়টি তুলে ধরেন আইজেনব্রাউন।

তবে, যুত্তরাষ্ট্র কাদের দ্বারা মুজিববিরোধী অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করছিল সেটা আইজেনব্রাউন যেমন প্রকাশ করেননি তেমনি অন্য কেউ-ও না।

তার সাক্ষাতকারে অবশ্য স্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখলেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অবস্থান, সোভিয়েত ঘেঁষা নীতি ও সমাজতন্ত্রের পথে যাত্রা ওয়াশিংটনের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না। তার দাবি, রাষ্ট্রদূত বোস্টার যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ মুজিবের হাতের দূরত্বে রাখতে চাইলেও সেটা হয়নি। এসব কারণে দু’ দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক শীতল ছিল আর মুজিবকে উপেক্ষা করছিলেন কিসিঞ্জার।

Exit mobile version