নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে স্বাধীন হবার পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ছাড়াও তৎকালীন সরকারের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা। সেই কঠিন সময়ে বাংলাদেশকে সবার প্রথমে স্বীকৃতি দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র ও সম্ভাবনাময় দেশ ভুটান। তখন থেকেই দুদেশের নেতা ও মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় আত্মিক সম্পর্ক, বিশ্বাস ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুগ্মভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতাকারী অন্যতম দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এরইমধ্যে সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ভুটান, তারাই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যদিও এ নিয়ে সংশয় ছিলো, কে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভুটান না ভারত?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে ভুটানের স্বীকৃতি প্রদানের আনুষ্ঠানিক খবর তারবার্তার মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কাছে পৌঁছার কয়েক ঘণ্টা পর আরেকটি তারবার্তার মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশ সফরে এলে এ বিষয়ে সরকারের কাছে নতুন তথ্য উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে দেশটির দালিলিক তথ্য-প্রমাণ ও স্বীকৃতি প্রদানের তারবার্তা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। এতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক এক তারবার্তায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়। শুধু ভুটান সরকারই না, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভুটানের সাধারণ জনগণ এবং সুশীল সমাজ বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি গণহত্যার প্রতিবাদ করে গণমাধ্যমে।
ভুটান যে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে, তা সরকারিভাবে গৃহিত। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভুটানকে প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক। ওই সফরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভুটানের রাজার মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে উভয় নেতা নিজেদের বন্ধুত্বকে জোরদার করেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তৎকালিন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিংকে দেয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদা। সেসময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুটানের বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবার স্মৃতিচারণ করেছিলেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।
সেদিন স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ওই দিনটির কথা আমি কখনও ভুলতে পারি না। এ কারণে যে তখন আমরা বন্দি শিবিরে ছিলাম। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেমন আমার বাবা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে আমার মাকে গ্রেপ্তার করে। সেদিন আমি, আমার ছোট বোন রেহানা, ছোট্ট রাসেল এবং আমার ছোট্ট জয় মাত্র ৫ মাসের একটা শিশু। আমরা সবাই কিন্তু বন্দি খানায়। সেদিন রেডিওতে আমরা প্রথম যখন শুনতে পারলাম যে ভুটান আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সেটা আমাদের জন্য একটা অনন্য দিন ছিল। হাসি কান্নার মধ্য দিয়ে সেই দিনটি আমাদের কেটেছিল। কাজেই আমরা সব সময় ভুটানের কথা স্মরণ করি।’
ভুটান সরকার ও জনগণের অবদানের কথাও স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভুটানের প্রয়াত মহামান্য তৃতীয় রাজা জিগমে দোর্জি ওয়াংচুক এবং সেদেশের জনগণ স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের শুধু সমর্থনই দেননি, সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ভুটানের তরুণেরা ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আহত এবং অসুস্থ বাঙালি শরণার্থীদের সেবা করেছিলেন। ভুটানই প্রথম দেশ যে নাকি স্বাধীন বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী ভুটানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির দিনটিকে দু’দেশ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এ চুক্তির ফলে ভুটান তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য এবং ইলেকট্রনিক্সসহ ১০০টি বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্য রফতানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান করতে সম্মত হয়। অন্যদিকে ফলমূলসহ ৩৪টি ভুটানের পণ্য বাংলাদেশে একই সুবিধা পাবে। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের যাত্রা শুরু হয়। এভাবেই বন্ধুত্বের প্রতিদানের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ভুটানের প্রচুর শিক্ষার্থী বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আসে যুগ যুগ ধরে। পর্যটন ক্ষেত্রে ভুটানকেও বেছে নেয় বাংলাদেশের ভ্রমণপ্রিয় জনগণ। বাংলাদেশ ও ভুটান সরাসরি রেল যোগাযোগও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উভয় দেশ একটি কৌশলগত উন্নয়ন অংশীদারত্বের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেমন জল শক্তি, শুল্কহীন বাণিজ্য এবং পরিবহন। আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ বিভিন্ন ফোরামে যেমন: সার্ক, বিমসটেক, কলম্বো প্ল্যান, বিবিআইএন ইত্যাদির মাধ্যমে দুদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে সাফল্য লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে ভুটানের সহযোগিতা এবং কার্যকর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে মহামারি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ভুটানকে জরুরিভাবে ওষুধ সরবরাহ করেছিল। বাংলাদেশের এ মানবিক উদ্যোগটি দুদেশের জনগণকে অনেক কাছে টেনে এনেছে।
এবছর স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় পাশে রেখেছেন ভুটানের রাজাকে। সফরকালে দুইদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও। মহান স্বাধীনতার প্রতিটি পর্বেই কৃতজ্ঞতা ভরে এভাবেই স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে ভুটানকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)