হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পরিস্থিতি। একদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকার কর্তৃক আরোপিত সাড়ে সাত ভাগ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাস্তাঘাট বন্ধ করে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলন করছে।
এই আন্দোলনের কারণে দুর্ভোগে-যন্ত্রণায় রাজধানীবাসীর মধ্যে নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্য দিকে উচ্চ শিক্ষা লাটে উঠতে বসেছে। অথচ এ নিয়ে কারও মধ্যে কোন বিকার দেখা যাচ্ছে না।
গত জুনে জাতীয় বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা পরে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। এর প্রতিবাদে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই ভ্যাট শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলে দিয়েছে, ছাত্রদের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। ভ্যাট পরিশোধ করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।তিন মাস ধরে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি উত্থাপন ও এ-সংক্রান্ত বক্তব্য-বিবৃতির ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন।
এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। তাঁদের সরাতে পুলিশ লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এতে অনেকে আহত হন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শটগানের স্প্লিন্টার বিদ্ধ শরীরের ছবি রাতেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনে নামতে আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর থেকে রাস্তায় নামতে থাকেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।গত বৃহস্পতিবার থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই রাস্তা অবরোধ করে রাখছেন। এতে করে রাজধানীবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ নিরসনে আন্দোলকারী শিক্ষার্থী কিংবা সরকার কাউকেই সংবেদনশীল হতে দেখা যাচ্ছে না। ভ্যাট কে দেবে, তা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী প্রথমে বলেছিলেন, শিক্ষার্থী নয়, ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থমন্ত্রী আবার যখন বলেন, এ বছর না হলেও আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থীদেরকেই ভ্যাট দিতে হবে-তখন শিক্ষার্থীরা আবারও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহোরের দাবিতে অনড় অবস্থানে চলে যায়। আমরা সবাই জানি শেষ পর্যন্ত ভোক্তারাই ভ্যাটের টাকাটা দেয়, কোন মালিক দেয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ভ্যাট দিলেও সেটা তাদের লাভের টাকা থেকে দেবে না, তারা এই টাকাটা যেভাবেই হোক ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করবে, যে নামেই করুক। কাজেই এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান পরিবর্তন হওয়া দরকার। এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। ব্যবসায়ীরা শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখতে পারে। ওটা তাদের বাণিজ্য-ধর্মের সঙ্গে খাপ খায়। কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না, তাই সে কেন শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখবে? এখান থেকে ভ্যাট নেয়াটা রাষ্ট্রের মৌল নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের শিক্ষার অধিকারে কথা বলা আছে। সবার শিক্ষার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা যায়নি-এজন্য তো বরং সরকারের কুণ্ঠিত-লজ্জিত হওয়া উচিত। এটা পারলে তো আর এমন সাড়ে সাত ভাগ ভ্যাট প্রদানের বিষয় নিয়ে এমন উটকো ঝামেলা পোহাতে হতো না।আর দেশে এতোকিছু থাকতে শিক্ষা খাতেই কেন ভ্যাট বাড়াতে হবে? ‘প্রাইভেট’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে? তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় নি বলে বাড়তি এই করাঘাত? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দেশে এতো কিছু থাকতে শিক্ষায় ভ্যাট কেন?
আমাদের জানা মতে, সাধারণত কোন জিনিসের আমদানি বা ভোগ নিরুৎসাহিত করতে অতিরিক্ত ট্যাক্স বা ভ্যাট বসানো হয়। যেমন-বিলাসবহুল গাড়ি, ফ্রিজ, মদ, সিগারেট, গাঁজা ভাঙ ইত্যাদি। তবে কি শিক্ষাও বিলাসবহুল বা ক্ষতিকর পণ্য হয়ে গেল? মদ-সিগারেট-গাঁজা-ভাঙের মতন? শিক্ষাকেও বিলাসবহুল বা ক্ষতিকর পণ্যের মতো নিরুৎসাহিত করতে হবে?
ভ্যাট আদায়ে সরকারি নীতিও প্রবল ভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসবহুল শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিতে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা। এই ধারা এখনও চলছে। মন্ত্রী-এমপিরা বিনা শুল্কে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করবে আর শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার জন্য ভ্যাট দেবে-এটা কোন গণতান্ত্রিক সরকারের বিধান হতে পারে না। যে মন্ত্রী বা এমপি ৫ কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি আমদানি করতে পারে, সে কেন শুল্ক দিতে পারবে না? রাষ্ট্র কেন তাদের গাড়ির শুল্কের দায় নেবে? তাই যদি নেয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভ্যাটের দায় কেন নেবে না?
সংবিধানে সকল নাগরিকের সমানাধিকারের কথা বলা। সবার জন্য শিক্ষার অধিকার কথাও বলা আছে। ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে অলাভজনক ও সেবামূলক। ২০১০ এ মালিকদের স্বার্থে বেসরকারি অধ্যাদেশ বিভিন্ন ধারার শব্দ ও ভাষার কৌশলগত পরিবর্তন এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খরচ, মালিকদের মুনাফা শিক্ষার্থীর ফি’র উপর নির্ভরশীল করা হয়। সরকারের এই নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা দরকার।
সবার আগে দরকার অনতিবলিম্বে আরোপিত এই ভ্যাট তুলে নেয়া। শুধু তাই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা চার্জ করে, সেটা কতোটা যৌক্তিক তা মূল্যায়নের জন্যও একটা ‘ইনডিপেন্ডেন্ট কমিশন’ করে দেয়া দরকার। দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৩টি, যেগুলোর মধ্যে গুণগত মান বজায় রাখতে পারছে বড়জোর ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। বাকিগুলোর লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একের পর এক মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়ায় বেসরকারি পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা ঘিরে নৈরাজ্য চলে আসছে, অভিযোগ রয়েছে সনদ কেনাবেচারও। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবেদনে এই ধারার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে।কিন্তু সেগুলোর সমাধান না করে শুধু করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নৈরাজ্যকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে। ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে তা নৈরাজ্যমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার যত দ্রুত ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করবে মতই মঙ্গল!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)