অর্থমন্ত্রী দেশে ভিক্ষুক নেই বললেও তার সময়েই এদেশে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো, জাতীয় বাজেটে অর্থও বরাদ্দ করেছিলেন তিনি। তবে ‘নামকাওয়াস্তে’ পুনর্বাসনের নামে জরিপের তথ্য সংগ্রহ এবং কিছু প্রচার-প্রচারণাতেই সোয়া ২৩ কোটি টাকা খেয়ে ফেলেছে ১০টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)। পুনর্বাসিত হয়েছে মাত্র ৩৭ জন।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ কর্মসূচি শুরু করা হয়। তবে ওই অর্থ বছরে কর্মসূচির অনুকূলে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। ২০১০-১১ অর্থ বছরে কর্মসূচি খাতে ছয় কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থ বছরে সাত কোটি টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থ বছরে আরো ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
পাইলট ভিত্তিতে ঢাকা মহানগরে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য জরিপের কাজও হাতে নেওয়া হয়। জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকা মহানগরীকে ১০টি জোনে ভাগ করে ১০,০০০ ভিক্ষুকের উপর জরিপ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করা হয় ১০টি এনজিও।
কিন্তু ওই সময়ে ঢাকা মহানগরে প্রকাশ্য রাজপথে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারের উদ্দেশে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকায় ভিক্ষুক জরিপ কাজে কোনো আইনগত বাধা হবে কিনা সে বিষয়ে এটর্নি জেনারেলের মতামতও নেওয়া হয়। পরে ১০ এনজিওর মাধ্যমে মহানগরীর ১০টি জোন থেকে এক হাজার জন করে নিয়ে মোট দশ হাজার ভিক্ষুকের জরিপ সম্পন্ন হয়।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ডাটাবেইজ তৈরি করা হয়েছে। গণমাধ্যমে কিছু প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি ওই ১০ হাজার ভিক্ষকের মধ্যে এক হাজার জনকে ময়মনসিংহ জেলায়, ৫০০ জনকে বরিশাল জেলায় এবং ৫০০ জনকে জামালপুর জেলায় পুনর্বাসন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত শুধু ময়মনসিংহে ৩৭ জনসহ খুব অল্প সংখ্যক ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ভিক্ষুক আছে ভিক্ষুক নেই
রাজধানীতে নিয়মিতই ভিক্ষুক দেখা গেলেও এবং সরকারের ভিক্ষুক পুনর্বাসের প্রকল্প থাকলেও সমাজসেবা অধিদপ্তরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো ভিক্ষুকের উপস্থিতি মানতে নারাজ। রাজধানীতে যে শতশত ভিক্ষুক দেখা যায় তাদেরকে অধিদপ্তর ভিক্ষুকের স্বীকৃতি না দিয়ে মৌসুমি ভিক্ষুক বলতে চায়।সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবীর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সারা ঢাকা শহরে যারা এখন ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত তারা সবাই সিজনাল; এর টানা পাঁচ দিন রিক্সা চালায় আর দুইদিন ভিক্ষা করে। বিশেষ করে রমজান মাস আর শুক্রবার যারা হাত পাতে ভিক্ষার জন্য, তারা কেউ ঢাকা শহরের নয়। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকা শহরে এসে ভাসমান হিসেবে আশ্রয় নেয়।
তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘আসেন আগারগাঁ এসে দেখেন, কোনো ভিক্ষুক খুঁজে পাবেন না।’
কিন্তু অর্থমন্ত্রী এবং অধিদপ্তরের দাবি নাকচ করেছে ভিক্ষুকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর কথা ঠিক না; কারণ উনি হালনাগাদ তথ্য জানেন না।
‘ঢাকা শহরের যে জায়গাগুলোতে ভিক্ষুক নেই বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে, সে সব জায়গায়ও দেখা যায় সাইনবোর্ডের নীচে পুলিশের সামনে ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করছে,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিভিন্ন তথ্যমতে, ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ হাজার ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। আসলে ভিক্ষুকের সংখ্যা কতো হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদা বানু বলেন, সঠিক সংখ্যা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে ২০০৯ সালের একটি জরিপ রির্পোট অনুযায়ী তখন রাজধানীতে দশ হাজার ভিক্ষুক ছিলো। এখন নিশ্চয়ই এ সংখ্যা বেড়েছে।
প্রচারণাতেই শেষ ভিক্ষুক পুনর্বাসন তহবিল
সমাজসেবা অধিদপ্তর যে ২৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা খরচ করে ৫০ জন ভিক্ষুককেও পুনর্বাসন করতে পারেনি এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মো. নুরুল কবীর বলেন, আমি নতুন এসেছি। এ বিষয়ে বলতে পারবো না।
‘তবে যতটুকু জানি প্রচার-প্রচারণার কাজে টাকা খরচ হয়েছে। বাকি টাকা ফেরত এসেছে।’
প্রকল্প থাকুক বা না থাকুক, এখন রাজধানীর সব এলাকাকে ক্রমান্বয়ে ‘মৌসুমী ভিক্ষুকমুক্ত’ করার কার্যক্রম চলছে বলেও বলেও জানান তিনি।
ভিক্ষা করতে চায় না ৯৭ শতাংশ ভিক্ষুক
দেশে ভিক্ষুকের উপস্থিতি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দ্বিমত থাকলেও এক বিষয়ে তারা একমত যে দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া ভিক্ষুকরাও ভিক্ষাবৃত্তিতে থাকতে চায় না।
‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’-এর নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, ২০০৫ সালে রাজধানীর ১৪টি পয়েন্টে এক হাজার ভিক্ষুকের উপর গবেষণায় দেখা যায় ৯৭ শতাংশ মনে করে, সরকার আইন করে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে পারে। এদের বেশিরভাগ নিজেরা স্বাবলম্বী হতে কাজ চায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য সিন্ডিকেটের কথা বলেছে। ওই জরিপে দেখা যায়, মাত্র তিন শতাংশ ভিক্ষুক এ পেশার সঙ্গেই থাকতে চায়।