অফিস-আদালত, গার্মেন্টস-উপাসনালয় কিংবা দোকানপাট-গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করেও সরকার মানুষকে ঘরে রাখতে পারছে না। এমন কি লকডাউন-শাস্তি-জরিমানার মতো আপাতত কঠিন অবস্থানেও বাধ্য করা যাচ্ছে না তাদেরকে ঘরে রাখতে। অর্থাৎ কোনো কিছুতেই এক শ্রেণির মানুষকে বোঝানোই যাচ্ছে না; করোনাভাইরাসের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঘরে থাকলে তার নিজের লাভটাই সবার আগে।
কিছু মানুষের যখন এমন অবস্থা, তখন ক্রমশ দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলেছে। শুধু বেড়ে চলছে বললে ভুল হবে। আসলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সেটা হোক মৃতের সংখ্যায় বা আক্রান্তে। এরপরও আমরা চোখ বন্ধ করে রাস্তায় ঘুরছি, হাটে-বাজারে ভিড় করে কেনাকাটা করছি। আড্ডায় মেতে উঠছি চায়ের দোকানে আর তাস-ক্যারাম খেলায়। যেন স্বয়ং করোনাভাইরাস কানে কানে বলে গেছে, ‘কিছুই হবে না’।
সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে। এক যুবক শরীরে করোনাভাইরাস নিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে ঘাটাইল চলে যায়। গতকাল শুক্রবার প্রায় মধ্যরাতে যখন তাকে অনেক খোঁজাখুঁজির পাওয়া গেল, ততক্ষণে সে গুচ্ছ সংক্রমণ বা কমিউনিটি সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে ফেলেছে। যদিও তা মোকাবেলা ওই এলাকার ১২০ পরিবারকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কি রক্ষা হবে? ওই যুবক ঢাকা থেকে ঘাটাইল পর্যন্ত এই দুইদিনে কত শত মানুষের সংস্পর্শে গেছে? সেসব মানুষকে লকডাউন করবে কিভাবে? আবার এসব মানুষ নতুন আর কত সংখ্যক মানুষকে স্পর্শ করেছে, সেই খবর কে জানে? আদৌ কি তা জানা সম্ভব?
অথচ এই যুবক গত ৭ তারিখে যেদিন ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন, সেদিনই করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহ করে তার নমুন সংগ্রহ করে আইইডিসিআর-এ পাঠানো হয়েছিল। দুইদিন পর আরও নিশ্চিত হয়ে তাকে কুর্মিটোলায় ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। এখানেই সবচেয়ে প্রশ্ন; তাকে কেন একা ছেড়ে দেওয়া হলো? ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেই কেন বিশেষ নিরাপত্তায় তাকে কুর্মিটোলায় পৌঁছে দেয়া হলো না? আর পাশেই তো সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও আইসোলেশন ব্যবস্থা ছিল। তাহলে? এর একটাই উত্তর অব্যবস্থাপনা। করোনাভাইরাস আক্রান্ত বা করোনাভাইরাস সন্দেহে অনেকক্ষেত্রে এমনই হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার পাশের দেশ নিউজিল্যান্ডে ঘটেছে আরেক শিক্ষণীয় ঘটনা। গত ৭ এপ্রিল লকডাউন না মেনে পরিবার নিয়ে সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক নিজেকে নির্বোধ ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে সংকটময় পরিস্থিতির কারণে তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদে রাখা হলেও শাস্তি হিসেবে হারাতে হয়েছে আরেকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
নিউজিল্যান্ডের এই ঘটনার দুইদিন আগে ৫ এপ্রিল লকডাউন অমান্য করায় স্কটল্যান্ডের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ক্যাথরিন ক্যাল্ডারউডকে পদত্যাগ করতে হয়। তিনি ভুল স্বীকার করে বলেন, যেসব উপদেশ আমি অন্যদের দিচ্ছি, অথচ সেগুলো নিজেই মানিনি। এর জন্য ভীষণ লজ্জিত।
এটা তো ঠিক, সরকার ইতালির মতো রাস্তায় বের হলেই ৫০ হাজার ইউরো (প্রায় ৫০ লাখ টাকা) জরিমানার বিধান রাখেনি। কোয়ারেন্টাইন ভাঙলে ৫ বছরের কারাদণ্ড রেখে নতুন আইন করেনি। আবার রাশিয়ার মতো অন্যের শরীরে রোগ ছড়ালে ৭ বছর কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করেনি। শুধু এই দুটি দেশই না; আরও কিছু কিছু দেশ করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আইন সংশোধন, পরিবর্তন বা নতুন করে করেছে। কেননা তারা জানে ভালো কথা কারো কারো কানে পৌঁছে না। সেই কারো কারো জন্য একটু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেই হয়।
করোনাভাইরাস ঠেকাতে অন্য দেশগুলোর মতো আইন সংশোধন বা নতুন আইনের পথে হাঁটেননি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। তিনি আরও কঠোর অবস্থানে গিয়ে লকডাউন অমান্যকারীদের সরাসরি গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)